ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় কাটছে ‘জোব্বা’, ‘পাঞ্জাবি’ ও ‘গেঞ্জি’র কারিগরদের। এগুলোর একটিও পরিধেয় বস্ত্র নয়। এক হাজার টাকার জাল নোটকে বলা হয় জোব্বা, পাঁচশ টাকার নোট পাঞ্জাবি, আর গেঞ্জি হলো একশ টাকার নোট। জাল নোট তৈরি ও বিপণনে জড়িত চক্রের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় এ রকম ছদ্মনাম ব্যবহার করে। এতে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ঈদকে টার্গেট করে প্রচুর জাল নোট তৈরি করে কৌশলে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ২৩টি প্রতারক চক্র। আসলের মতোই প্রায় ‘নিখুঁত’ হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে জাল নোট চেনা মুশকিল। এসব চক্রের ঘাঁটি ঢাকায়। তবে চট্টগ্রামে কাজ করছে তাদের শাখা ও উপশাখাগুলো, যারা কমিশনের ভিত্তিতে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে ঈদবাজারে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জাল নোট হাতে এলে উভয় সংকটে পড়তে হয়। প্রথমত আর্থিক ক্ষতি হয়, দ্বিতীয়ত প্রশাসনের কাছে গেলে নিজের উপরই নেমে আসে নানা ঝামেলা। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে জাল নোটসহ ধরা পড়ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। সর্বশেষ গতকাল নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা মূল্যের জাল নোটসহ ইমাম হোসেন (৩২) নামে এক যুবককে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর দুদিন আগে পাহাড়তলী থানার অভিযানে জাল নোটসহ একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাগরিকা গরুর হাটের কাছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম গেটের সামনে বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়ে এক হাজার টাকার ১০টি জাল নোটসহ ইমন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবি মহানগর বন্দর ও পশ্চিম জোনের উপকমিশনার (ডিসি) আলী হোসেন বলেন, ঈদের আগে আর্থিক লেনদেন বেড়ে যায়। এ সুযোগে তৎপর হয়ে ওঠে জাল নোট ব্যবসায়ীরা। জাল নোট তৈরিতে জড়িত বেশ কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করা গেছে। পশুর হাটে ভিড়ের সুযোগ যাতে কোনোভাবেই জাল নোট কারবারিরা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে তিনি পশুর হাটের ইজারাদার ও পশু বিক্রেতাদের সতর্ক থাকার অনুরোধ জানান।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, জোব্বা অর্থাৎ এক হাজার টাকার জাল নোটের ১০০টির এক বান্ডিলের দাম পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। পাঞ্জাবি বা ৫০০ টাকার জাল নোটের ২০০টির বান্ডিলের দাম আট থেকে ১০ হাজার টাকা। এগুলো হলো পাইকারি দাম। এরপর কয়েক ধাপে হাত ঘুরে জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জাল নোটের সর্বশেষ ক্রেতা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকায় এক লাখ টাকার সমপরিমাণ জাল নোট কেনে। লাভ কম হয় বলে গেঞ্জি বা ১০০ টাকার জাল নোট এখন সাধারণত ছাপা হয় না। সাধারণত সর্বশেষ ধাপের বিক্রেতারা আইন–শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা চক্রের হোতাদের চেনেই না। এ কারণে চক্রের মূল অপরাধীদের গ্রেপ্তার বা জাল টাকার কারখানার সন্ধান পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
জাল নোট ও আসল নোটের পার্থক্য প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের নোটের কাগজ সবচেয়ে বেশি টেকসই ও উন্নতমানের। এই কাগজের ৯০ ভাগ সুতা ও ১০ ভাগ সিনথেটিক। এই কাগজের শোষণক্ষমতা একেবারেই কম। যে কারণে পানি দাঁড়ায় না। বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোও এই কাগজ তৈরি করতে পারে না। কোনো জাল নোটেই এই কাগজ পাওয়া যাবে না। সুতা ব্যবহারের মাধ্যমে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি কোথাও নেই। একমাত্র ইংল্যান্ডের একটি কোম্পানি এটা তৈরি করে। নোটে ব্যবহার করা হয় অপটিক্যাল ভেরিয়েবল ইংক বা ওভিআই। যে কারণে এই নিরাপত্তা চিহ্নটির রং পরিবর্তন হয়। জাল নোট হয় রঙিন ফটোকপি করে। তাতে নিরাপত্তার দিকগুলো থাকে না। আসল নোটটি তৈরি হয় লম্বা রেখা দিয়ে। কিন্তু সাধারণ কাগজ তৈরি হয় ডট দিয়ে। জাল নোট অনেক বেশি ঝকঝকে হয়। কিন্তু সুতায় তৈরি হয় বলে আসল নোট ততটা ঝকঝকে হয় না। সাদা কাগজে ঘষলে আসল নোটের সামান্য রং উঠতে পারে। কিন্তু জাল নোটের উঠে না। কারণ এর কাগজ অপসেট পেপারের এবং শোষণমাত্রা বেশি।
সিএমপির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, দেশে জাল নোট ছড়াতে ব্যস্ত ২৩টি চক্র। এর প্রধানরা হলো মো. সেলিম, রাকিব হোসেন, হুমায়ুন কবির, জাহাঙ্গীর আলম, ছগির মাস্টার, সাইফুল ইসলাম, মো. সুমন, পলাশ মিয়া, আলাউদ্দিন, কাওছার হোসেন, জাকির হোসেন, আবদুর রশীদ, মাহবুব মোল্লা, মো. জহির, মো. আবদুল্লাহ, মিন্টু ওরফে রাজা, হাবিবুর রহমান, রুবিনা আক্তার, মামুনুুর রহমান, আয়নুল হক, সোলায়মান মজুমদার, পারভেজ আহমেদ ও আবুল কালাম।
গোপনীয়তা রক্ষা ও অবৈধ কারবারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখতে চক্রগুলো একে অন্যের সঙ্গে সমঝোতা করে চলে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরিবিলি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে কম্পিউটার, প্রিন্টার ও স্ক্যানার বসিয়ে চার–পাঁচজনে মিলে জাল নোট ছাপানোর কাজ করে। একটি চক্রে উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত ১৫–২০ জন জড়িত থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, জাল টাকা লেনদেন, গ্রহণ, বহন ও ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় এই টাকা হাতে পেয়ে বিব্রত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে পাওয়া জাল নোট ব্যাংকে ফেরত দিয়ে বদলে নিতে গিয়ে পড়ছেন বিড়ম্বনায়। টাকা ফেরত না দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছেন গ্রাহককে। নিয়মমাফিক পাঞ্চ মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে দিচ্ছেন নিয়ে আসা জাল নোট। ফলে টাকা ফেরত পাওয়ার বদলে উল্টো শাস্তির ভয়ে আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে প্রতারিত গ্রাহককে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বাজারে নতুন নোট ছাড়ার সময় জাল টাকার ব্যবসায়ীরা অধিকতর তৎপর হয়ে ওঠে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চট্টগ্রামের সব তফসিলি ব্যাংককে বিশেষ বুথ খুলে জাল টাকা শনাক্তকরণে হ্যান্ডবিল বিতরণসহ গ্রাহকদের সচেতন করে তোলার বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। সে অনুযায়ী একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।