জামিনে গিয়ে লাপাত্তা ওরা

আছে দুর্নীতি চোরাচালান মাদকসহ চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায়, বিচার শুরুর আগে কিংবা রায় ঘোষণার কয়েকদিন আগে জামিনে থেকে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিরা। ২০১৫ সালে বন্দরে কোকেন চালান আটকের আসামি, কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতি মামলা, হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার অনেক আসামি জামিনে যাওয়ার পর বছরের পর বছর তাদের হদিস মিলছে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী আজাদীকে বলেন, জামিনে গিয়ে পলাতক থাকলে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করাসহ বিভিন্ন কারণে মামলার বিচারিক কার্যক্রমে বিলম্ব হচ্ছে। তাই বলে জামিনের বিষয়টি বন্ধ করা যায় না।
তিনি বলেন, জামিন পাওয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। তবে চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এ ধরনের মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে যখন কোর্ট মনে করবে তারা জামিনে গেলে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে তাদের জামিন দেওয়ার বিষয়টি সতর্কতার সাথে ভেবে দেখা উচিত। তিনি আরো বলেন, যারা আসামিদের জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে জিম্মাদার হিসেবে থাকেন, আসামি পালিয়ে গেলে জিম্মাদারদের বিরুদ্ধে আইনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের শাস্তির বিধান দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পিপি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, জামিনে গিয়ে আসামি পলাতক থাকলে সাময়িক সমস্যা তৈরি হলেও বিচারিক কার্যক্রমে তেমন প্রভাব পড়ছে না। পলাতক আসামিদের অনুপস্থিতিতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলমান থাকছে।
২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের সর্ববৃহৎ কোকেন চালান আটকের ঘটনায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খান জাহান লিমিটেডের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ, তার ভাই মোস্তাক আহম্মদসহ দশ আসামির বিরুদ্ধে করা মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। গত বছরের ২৯ এপ্রিল মাদক আইনে এবং একই বছরে ২৯ জুন চোরাচালান আইনে পৃথক অভিযোগপত্র গঠনের মাধ্যমে এ বিচারকার্য শুরু হয়েছে।
মহানগর আদালতের তথ্যমতে, কোকেন মামলায় চার্জ গঠনের আগেই নুর মোহাম্মদ জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন। তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। তার ভাই মোস্তাক আহমেদ শুরু থেকেই পলাতক। এছাড়া এ মামলার দুই আসামি ফজলুর রহমান ও বকুল মিয়া শুরু থেকেই পলাতক। এরা বর্তমানে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছেন। বাকি ছয় আসামির মধ্যে গোলাম মোস্তফা সোহেল ও আতিকুর রহমান কারাগারে রয়েছেন। জামিনে রয়েছেন মেহেদী আলম, একেএম আজাদ, সাইফুল ইসলাম ও মোস্তফা কামাল।
আদালতের তথ্যে, ইতোমধ্যে এ মামলায় চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বর্তমানে জামিনে ও হাজত থাকা অন্য ৬ আসামি মামলার ধার্য তারিখে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী।
২০১৬ সালে আগ্রাবাদ এবি ব্যাংকের ৩২৫ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ৯৫৫ টাকা ও হালিশহরে সাউথইস্ট ব্যাংকের ১৩৫ কোটির অধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা পৃথক মামলায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে পলাতক বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর স্ত্রী রাইজিং স্টিল মিল লিমিটেডের চেয়ারম্যান জামিলা নাজনীন মাওলা।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, ২০১৮ সালে দুদকের পৃথক দুটি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর আগেই তিনি জামিনে গিয়ে এখনো পলাতক রয়েছেন। আগ্রাবাদ এবি ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রধান আসামি আসলাম চৌধুরী বর্তমানে কারাগারে আছেন। একই মামলায় আসামি আসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই আমজাদ হোসেন চৌধুরী ও জসিম উদ্দিন চৌধুরী মামলার পর থেকেই পলাতক।
সাউথইস্ট ব্যাংকের টাকা আত্মসাতেও আসলাম চৌধুরীর পাশাপাশি আসামি তার স্ত্রী জামিলা নাজনীন মাওলা। এ ঘটনায় দুদক ব্যাংকের এমডিসহ ব্যাংকারদের চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দিলেও হাই কোর্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর জন্য মহানগর দায়রা জজকে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু।
২০১৯ সালে পৌনে ৩ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলার আসামি পটিয়া থানার সাবেক ওসি রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন আদালতে নিয়মিত হাজির দিচ্ছেন না। একই মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন সাবেক ওসির দুই ভাই। অবৈধভাবে আয়ের টাকা দিয়ে দুই ভাইয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনে অবৈধ সম্পদ গোপনের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। দুদকের আইনজীবীরা জানান, দুদকের মামলায় পটিয়ার সাবেক ওসি রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী হাই কোর্টের জামিনে ছিলেন। জামিনের মেয়াদ শেষে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। বর্তমানে তিনি কাগজে-কলমে পলাতক রয়েছেন।
২০১৯ সালে সিআইডি চট্টগ্রামের এসআই নোয়াব আলী ও তার স্ত্রী গোলজার বেগমের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়। দুদকের এই মামলায় হাই কোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের জামিনে গিয়ে দুজনই পলাতক রয়েছেন। ওই বছরের জানুয়ারিতে চান্দগাঁও আবাসিকে চিকিৎসক আকাশের আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় নিহতের স্ত্রী মিতুসহ অন্য আসামিরা লাপাত্তা। ওই ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় দায়ের হওয়া মামলায় মিতু পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে জামিনে বেরিয়ে আসেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর আসামি মিতুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ২০১৪ সালে সদরঘাটে এক নারীসহ জোড়া খুনের ঘটনায় গত বছর ১৫ ডিসেম্বর হোটেল মালিকসহ ৫ আসামিকে যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছেন ৫ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। ওইদিন রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত জামিনে থেকে বাহারউদ্দিন নামে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি হাজিরা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আদালতে রায় ঘোষণার তারিখে এ আসামি পলাতক থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন মাদক, চোরাচালান, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি। জানা গেছে, আসামিরা জামিনে গিয়ে আত্মগোপনে থেকে বিভিন্ন সময় মামলার বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার, সাক্ষীদের হুমকিসহ নানাভাবে প্রভাবিত করা, মামলার বিভিন্ন সূত্র আড়ালের চেষ্টাসহ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের জন্য যাবতীয় চেষ্টা করে। সাধারণত আসামিদের একজন আইনজীবী ও স্থানীয় এক ব্যক্তির জিম্মায় জামিন দেয়া হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠানোই আমাদের মূল লক্ষ্য
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬