আমরা জানি বিদ্যার সাথে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে একইভাবে জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বিদ্যাও অর্থহীন যা পঙ্গু জাতির জন্ম দেয়। তাই বলা হয় শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ। প্রাণেই যদি ফুটো থাকে দেহ শ্বাস নিবে কীভাবে? শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিখন–শেখানোর একটি বৃত্তাকার প্রক্রিয়া আর এই প্রক্রিয়ার প্রধান উপাদানগুলোর একটা হচ্ছে পাঠ্যসূচি। একজন শিক্ষার্থীর বিবেক, ন্যায়পরায়ণতা, চিন্তা–চেতনা, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিক গুণাবলি ও আচরণের উপর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের প্রভাব শতভাগ। তাই শিক্ষাক্রমের সকল উপাদান সতর্কতার সাথে বাস্তবায়ন জরুরি। দক্ষ, শক্তিশালী, ধর্মীয় ও নৈতিকগুণের অধিকারী শিক্ষার্থী গড়ে উঠবে পরিকল্পিত শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে। একটি প্রজন্মকে দুর্বল ও নীতিবিবর্জিত করার জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। আসুন একবার ভাবি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কী? শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, আদর্শ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, শিষ্টাচার ও শৃঙ্খলা শেখায়, মৈত্রী–সৌহার্দ্য– সমঝোতার মেলবন্ধন তৈরী করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটায় এবং সর্বোপরি মানবসম্পদ গঠনে ভূমিকা রাখে। বিগত ২৫ বছরের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যক্রম দেশে গুণগত শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন তরান্বিত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন, যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি যুবসমাজের টেকসই অবনতির মাধ্যমে, যা তাদের চিন্তায়, চেতনায়, অনুভবে ও জ্ঞানে প্রতিফলন ঘটেছে। ফলাফলে পাসের আধিক্য বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। ৮০–৮৫ হাজার শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ–৫ পাওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। নীতি, আদর্শ, দেশপ্রেম, সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, সুশৃঙ্খল আচরণ এসব তাদের জন্য সিলেবাস বহির্ভূত বিষয়ের ন্যায়। তারা এখন গাইড, কোচিং ও প্রশ্নফাঁসের বাণিজ্যের কাছেই বন্দী। এমনকি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের লেকচার শোনার সময়ও তাদের হাতে নেই। শুধু পরীক্ষা আসলেই ওদের দেখা যায়। মূলত ওরা শিক্ষার্থী নয় পরীক্ষার্থী। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে হতাশ হয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ১২ টার পর বেশিরভাগ কলেজ ফাঁকা হয়ে যায়। শিক্ষক বসে থাকেন কিন্তু শিক্ষার্থী পালিয়ে যায়। শিক্ষকদের দায়িত্ব ক্লাসে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অন্তর স্পর্শ করা। কিন্তু নিষ্প্রাণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা আলো ছড়াবে কীভাবে! ২০১০ থেকে মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতিকে পিছনে ফেলে জ্ঞানী ও দক্ষ জনসম্পদ তৈরির জন্য চালু হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম নবায়ন, পরিমার্জন ও উন্নয়ন করা হয়। বাস্তবায়ন হয় চিন্তা নির্ভর, মননশীল শিক্ষাপদ্ধতি। কিন্তু পাঠ্যক্রম হয়ে যায় দুর্বল। আত্মীয়–স্বজনের অনেকেই দেখলাম এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার আগে পুরানো পদার্থ বিজ্ঞান,উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও ইংরেজি গ্রামার বইয়ের খোঁজে আমার বাসায় আসে। তাদের ধারণা শিক্ষক দম্পতির ঘরে হানা দিলে হয়তবা বইগুলো পাওয়া যাবে। তাই আমি বই তিনটি বারবার ধার দিয়ে ফেরত চাই। কেননা প্রতি বছর কেউ না কেউ একই উদ্দেশ্যে আমার বাসায় আসে। পরিবর্তিত পাঠ্যক্রম যদি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ক্ষিধে মিটাতে না পারে তবে এটার দরকার কী? যে সকল শিক্ষক পুরাতন বই কালেকশনের কথা ক্লাশে বলেন তারা প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় দুর্বল পাঠ্যক্রমের কথা বলেন না কেন? বিশেষ করে মফস্বলে এখনো অনেক হতদরিদ্র শিক্ষার্থী আছে যাদের পক্ষে সম্ভব নয় পাঠ্যবই বহির্ভূত বিষয়ের জ্ঞান নেয়ার জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া বা একটা স্মার্ট ফোন কিনে গুগল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। এদের অধিকাংশেরই অভিভাবক কৃষক, রিক্সা চালক বা শ্রমিক। তাদের পর্যাপ্ত তথ্য পেতে হলে পুরাতন বইয়ের খোঁজ নিতে হয়। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কতটা সৃজনশীল হতে পেরেছে তা শিক্ষকরা ভালোই জানে। শিক্ষকরাই এই পদ্ধতির অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ভালো করে বুঝে উঠতে পারেননি। বছরের পর বছর একই ধারায় প্রশ্ন প্রণয়ন ও খাতা মূল্যায়ন করা হয়। ভেবেছিলাম এই পদ্ধতি প্রণয়নের পর কোচিং সেন্টারের বিলুপ্তি ঘটবে, বরং তার উল্টো হয়েছে। আমার মতে পদ্ধতিটা আসলে তথ্য নির্ভর অর্থাৎ ইনফরমেটিভ বা কাঠামোগত, কেননা প্রশ্নে পর্যাপ্ত তথ্য এবং কাঠামো দেয়া থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা প্রশ্নে উল্লেখিত তথ্যের বাইরে গিয়ে নিজ থেকে দু–চারটে মানসম্মত লাইন অনুধাবন করে গুছিয়ে লিখতে পারে না বরং আজেবাজে লিখে খাতা ভরিয়ে রাখে। খাতায় তাদের প্রশ্নোত্তরের ধরন ও ভাষার ব্যবহার দেখে শিক্ষকদের হতাশ হতে হয়। তথাপি শিক্ষকরা কোন এক অজানা কারণে লিখলেই নাম্বার দিয়ে ফেলেন। আমাদের সময় শিক্ষকরা ক্লাসে বলতেন –শুধু লিখলে হবে না, ভালো নম্বর পেতে হলে যথার্থ উত্তর এর পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতারও প্রমাণ দিতে হবে। আমরা নিজেকে প্রস্তুত করেছি গাইড বিহীন, কোচিং বিহীন ও প্রযুক্তি বিহীন পরিবেশে শুধুমাত্র মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান ও শ্রেণি শিক্ষকের সহায়তায়।
বিগত ২০ বছর ধরে এইচএসসি তে ১০০ নম্বরের ইংরেজি প্রথম পত্র বইটির সিলেবাস আর বইয়ের মোড়ক ২ বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনবারই ইংরেজি সাহিত্যের প্রথিতযশা কবিদের কবিতা কিংবা প্রবন্ধ ছিল না। দুটো ছোট গল্প ছিল কয়েক বছর তাও এখন হারিয়ে গেছে। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম সংযোজন করা যায় যা থেকে শিক্ষার্থীরা নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রেরণা পেতে পারতো। এইচএসসি পাসের পরও শিক্ষার্থীরা ইংরেজি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য দু–একজন কবির নাম বা তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানে না। টেইলরের মতে শিক্ষাক্রমের চারটি স্তর হলো –লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, সংগঠন ও মূল্যায়ন। শিক্ষা কার্যক্রমের মেরুদণ্ড ঠিক রাখতে হলে আমাদের এই চারটি স্তরের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দর্শন, প্রয়োজনীয়তা, আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা,পরিবেশ ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক, যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাক্রম প্রয়োজন যা দ্বারা শহুরে ও মফস্বলের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে উপকৃত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।












