জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৩ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ


বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম কলঙ্কময় এক ঘটনার নাম জেলহত্যা। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জাতীয় চার নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম জাতীয় চার নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঘাতকচক্র রাতের অন্ধকারে পৃথিবীর সভ্যতার সকল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিরাপদ কারাগারে ঢুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল খুনিচক্র। তার ধারাবাহিকতায় জেলহত্যার মত নৃশংসতম ঘটনা ঘটে। এ হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নই, বিশ্ব মানবতার ইতিহাসেও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারাগারের নিরাপত্তা নীতি ভেঙে রাতের অন্ধকারে এভাবে জাতীয় নেতাদের হত্যার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা নিয়ে এবং দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পাকিস্তানী মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন অপচেষ্টার অংশই হলো ৩ নভেম্বরের নৃশংশতম হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ড বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। ৭৫ পরবর্তী ক্ষমতার মসনদে যারা আসীন হয়েছিলেন তাঁরা বিচার ব্যবস্থার সকল নিয়মকানুনকে পদদলিত করে খুনের বিচার যাতে না হয় সে বিষয়ে ইন্‌ডেমিনিটি আইন পাশ করে। ধিক্কার জানাই আজকের এ দিনে তাদেরকে। শহীদ জাতীয় এ চার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের নিয়ে সামান্য কথা এখানে তুলে ধরছি।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম :
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নে বীরদামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৯ সালে আয়কর কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি জীবন শুরু। ১৯৫১ সালে চাকরি ছেড়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে যোগদেন। অধ্যাপনাকালেই ‘ল’ পাস করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ বারে যোগদেন এবং আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তদানীন্তন পাকিস্তান গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ হতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির গুরু দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য ও সহানুভূতি অর্জনে তাঁর গৃহীত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মূল্যবান অবদান রাখে। মুক্তিযুদ্ধের সমন্বয় সাধনেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় এবং ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে আসে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু নিজের স্বপ্নের দেশ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রিত্বে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৭৫ এর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। খন্দকার মোশতাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানালে ঘাতক বাহিনী তাঁকে ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করে। অপরাপর নেতার সঙ্গে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। ৩ নভেম্বর তাঁকে জেল খানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ :
১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনায়, যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান শত্রু কারাগারে বন্দী এবং যখন বাঙালি জাতি বিভ্রান্ত, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করে যে কর্তব্য সম্পাদন করেন তা এককথায় অবিস্মরণীয়। ইতিহাস সঠিক সময়েই সঠিক মানুষটিকে নির্বাচন করেছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবার পর আরও তিনজন জাতীয় নেতাসহ তাকে বন্দী করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। সেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর বন্দী অবস্থায় ঘাতকের বুলেটে তিনি নিহত হন।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ এর ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খান।
১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নি। তিনি ঐ সময় বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রণ ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলে তা হবে তার দেশের জন্য অসম্মানজনক।’ অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ এর জাতীয় নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন। ঢাকা বনানী কবরস্থানে মহান এ বঙ্গবন্ধুপ্রেমী রাজনীতিবিদ্‌ তাজউদ্দীন আহমদকে দাফন করা হয়। প্রচার বিমুখ কর্মযোগী তাজউদ্দীন আহমদ একজন কোরানে হাফেজ ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি আরবীতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। একজন প্রজ্ঞাপন দূর দৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করে ছিলেন।
এম. মনসুর আলী ঃ
মোহাম্মদ মনসুর আলী একজন আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ছিলেন। সে হিসেবে তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্ম হলেও এম মনসুর আলীর আইন ব্যবসা, রাজনীতি চর্চার সূচনা ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু হয় পাবনাতেই। পাবনাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম জাতীয় নেতা।
১৯১৯ এর ১৬ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার কুড়িপাড়া গ্রামে এম মনসুর আলীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম হরফ আলী। কাজিপুরের গান্ধাইল স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে পাস করে সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুলে পড়াশোনা করে প্রথম বিভাগে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। আইএ পড়ার জন্য ভর্তি হন পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজে। তিনি বিএ পাস করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে, অর্থনীতি বিষয়ে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করার পর ঐ কলেজ থেকেই এলএলবি পাস করেন।
তিনি ১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ও দলকে সংগঠিত করেন।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদান করে কারাবরণ করেন। ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন অন্যতম মন্ত্রী। তিন দফায় তিনি সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ মার্চ ১৯৫৭ সংসদ ও আইন বিষয়ক, মার্চ ১৯৫৭, মার্চ ১৯৫৮ খাদ্য ও কৃষি এবং মার্চ-১৯৬৮-অক্টোবর ১৯৬৮ পর্যন্ত বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৯ সালে শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন। তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং বাঙালির মুক্তির সনদ ও ম্যাগনাকাটা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই পর্যায়েই ১৯৬৮ এর ২০ অক্টোবরে আওয়ামী লীগের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পাবনা-১ আসন হতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে গঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফিরে মন্ত্রী পরিষদ পুনর্গঠন করেন। প্রথমে যোগাযোগ ও পরে স্বরাষ্ট্র এবং যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে মনসুর আলী পাবনা-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল দলকে একত্রিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু করলে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী এ মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে ২৩ আগষ্ট ১৯৭৫ মোশতাক সরকার অন্যান্য নেতার সঙ্গে গ্রেফতার করেন। ঢাকার বণানী গোরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান ঃ
আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত স্বাধীন বাংলায় প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন নির্লোভ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তাঁর সকল পর্যায়ে গ্রহণ যোগ্যতা ছিল।
বর্তমান নাটোর জেলার অর্ন্তগত বাগাতিপাড়ার মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে ১৯২৬ সালের ২৬ জুন তারিখে এ.এইচ. এম কামরুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহী কাদিরগঞ্জ মহল্লায়। তিনি বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা আব্দুল হামিদ ও মাতা বেগম জেবুন্নিসা। ১২ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তার ডাকনাম ছিল হেনা। তিনি পরিচিত সকল মহলে হেনা ভাই নামে সমধিক সুপরিচিত।
১৯৫৬ সালে কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি দু’বার মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে আত্ম নিয়োগ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব খান সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫ জন সদস্য বিশিষ্ট দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেন। এই হাই কমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন কামরুজ্জামান।
১৯৭১ এর ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারে তাকে স্বরাস্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কামরুজ্জামান ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী । ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে তিনি মুক্তাঞ্চল, শরনার্থী শিবির ও সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করতেন।
১৯৭১ এর ২২ ডিসেম্বর তিনি অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রীবর্গসহ স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত সরকারের তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুজ্জামান। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাজশাহীর দু’টি সদর গোদাগাড়ি ও তানর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে ১৮ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রীসভায় তিনি শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ গঠন করলে তিনি কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। এ মহান নেতাকে রাজশাহী কাদিরগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
দেশে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এক সময় বিএনপি, জোট সরকারের শাসনকালে নিরাপত্তাহীন এক কালো অন্ধকারময় পরিবেশে আমরা দেখেছি, ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’ দেশে এখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের এবং ৩ নভেম্বরের সকল খুনিকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার আড়ালের মূল খল নায়েকরা এখনো বিচারের বাইরে থেকে গেছে।
জেল হত্যাকাণ্ডের এ দিনে আমি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের এবং ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের সকল কুশীলব, পরিকল্পনাকারী (হুকুমদানকারী) এবং আড়ালে বসে যারা ক্ষমতার কলকাটি নেড়েছেন তাঁদের সহ সকল বেনিফিশারিকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। এদের বিচার করা গেলেই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হবে, জাতি হিসেবে আমরাও দায়মুক্ত হতে পারব।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক : শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবই কিনি, বই পড়ি
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ : গন্তব্যের আরাধ্য প্ররোহ