গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশে প্রথমবারের মতো বাজারে প্রচলিত (মার্কেট রেট) সুদ হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৫টি জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের জানুয়ারি–জুন মেয়াদে মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে ১৫ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকেই এটি কার্যকর বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাজারভিত্তিক সুদহারের কারণে সঞ্চয় প্রবণতা বাড়বে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে বলে মনে করছে আইআরডি। অন্যদিকে এর ফলে বাজেটে সুদ ব্যয়ের চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ার কারণে এটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। তবে এতে সরকারি বাজেটে সুদের ব্যয় বাড়ে। সেই চাপটা বাড়াবে। এছাড়াও সঞ্চয়পত্র আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কারণে বিক্রি বাড়বে। আইএমএফের একটা শর্ত রয়েছে, সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের ঋণের পরিমাণ একটি বছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের ৪ ভাগের ১ ভাগের বেশি হতে পারবে না। সেটিও সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। তথ্যমতে, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের অধীনে পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক মেয়াদি হিসাবের সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ৫ বছর ও ২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারের সঙ্গে সংগতি রেখে ওই ৫টি সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার বছরে দুইবার পুনর্নির্ধারণ করা হবে। বিনিয়োগকারী ইস্যুকালীন বিদ্যমান মুনাফার হার, বিনিয়োগকালের পূর্ণ মেয়াদের জন্য প্রাপ্য হবেন। অর্থাৎ, ইস্যু করার সময় যেই মুনাফার হার ছিল, পুরো মেয়াদে একই হারে মুনাফা পেতে থাকবেন বিনিয়োগকারী। অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিকে সমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগকারীদের পূর্বের তিনটি ধাপের পরিবর্তে নতুন দুটি ধাপে (সাড়ে ৭ লাখ টাকা ও এর নিম্নে এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে) ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগের মতো বিনিয়োগের মেয়াদপূর্তির আগে নগদায়নের ক্ষেত্রে বছরভিত্তিক হারে মুনাফা পাওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বলেছেন, গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ সময়ে ব্যবসা–বাণিজ্যের গতিও শ্লথ হয়েছে।
সম্পদশালীদের মধ্যে যাঁরা নামে–বেনামে এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাঁদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। আবার কিছু ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে নগদ টাকা রেখে দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এছাড়া বিল–বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বিল–বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বিল–বন্ড ও ব্যাংকের আমানতে উচ্চ সুদের কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ যতটা কমেছে, তার চেয়ে বেশি কমেছে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই দুটি শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকে আমানতের সুদহার বাড়ার কারণে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহারও বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। কিন্তু আইএমএফের ঋণের শর্তের কারণে এই সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি গতি পায়নি। পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের প্রতি মাসে সুদের টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া ওয়েজ অনার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডসহ সঞ্চয় অধিদপ্তর পরিচালিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগগুলো মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করার সুবিধা বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেভাবেই হোক, দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য সঞ্চয়পত্রকে লাভজনক রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন। জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।