জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস প্রসঙ্গে

ফজলুল কবির মিন্টু | সোমবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল পালিত হয় জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস, যা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এই দিনটি শুধু একটি গতানুগতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের দিন নয়, বরং একটি সচেতনতামূলক প্রক্রিয়া যা আমাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেয়কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

বাংলাদেশে বহু ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে শ্রমিকরা, যেমন রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নি দুর্ঘটনা, চট্টগ্রামের কেটিএস গার্মেন্টসে অগ্নি দুর্ঘটনা, নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা, সীতাকুণ্ডের বি এম কন্টেনার ডিপোতে অগ্নি বিস্ফোরণএবং সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে অগ্নি দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনা কেবল আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে নাই, বরং দেশব্যাপী শ্রমিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চরম ঘাটতি ব্যাপকভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। আজকের দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করি সেই সকল শ্রমিককে যারা এসব দুর্ঘটনাসহ দেশের কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় প্রাণ হারিয়েছেন অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা

কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারেঅবকাঠামোগত ত্রুটির জন্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের কারণে অথবা বিভিন্ন বিষাক্ত ক্যামিক্যাল ও জীবাণুবাহী উপাদানের ব্যবহার থেকে। এসব কারণে শ্রমিকরা শারীরিকভাবে এবং পেশাগত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা তাদের জীবনের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপদ কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া, দীর্ঘ সময় ধরে একসঙ্গে একই পরিবেশে কাজ করা, অথবা শারীরিকভাবে অত্যধিক পরিশ্রমের কারণে শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে পারেন। এই সংকট থেকে উত্তরণে আর্গোনোমিক্সের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর্গোনোমিক্স বা মানবদেহের কাজের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিজাইন, কাজের ক্ষেত্রে শারীরিক চাপ কমিয়ে আনে এবং শ্রমিকদের জন্য অধিকতর নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের শিপ ব্রেকিং সেক্টর ও স্টিল মিল সেক্টরে ঝুঁকি

বাংলাদেশের একমাত্র এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং সেক্টর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত। এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টর হিসেবে বিবেচিত। যদিও ৭টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হিসেবে সনদ পাওয়ায় কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছে, তবুও গত বছর এস এন কর্পোরেশন নামক একটি গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় ৬ জন শ্রমিক নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। এর মাধ্যমে এই সেক্টরের ঝুঁকি এবং এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এই ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল ও উদ্যোগী হতে হবে।

এছাড়া, স্টিল এবং রিরোলিং মিল সেক্টর বাংলাদেশের আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টর, যার প্রতি অদ্যাবধি সেভাবে নজর দেয়া হয়নি। এখানে শ্রমিকরা প্রায়শঃ গুরুতর আহত হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা ক্ষতিপূরণ পায় না। ভবিষ্যতে এই সেক্টরের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরো গুরুত্ব সহকারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দুর্ঘটনা থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করতে শ্রম আইনের ৯০() ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক কারখানায় সেফটি ব্যবস্থাপনা গঠন ও তা কার্যকর করার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে আরো তৎপর হতে হবে। এটি শ্রমিকদের জন্য এক নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে খুবই জরুরী।

এছাড়া, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি চিহ্নিত, মূল্যায়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যথাযথ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এটি শুধু দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমিয়ে আনে না, বরং শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন ঘটায়।

শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। তবে, দেশের শ্রম আইনের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিধানগুলি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) কনভেনশন ১২১ এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই, আমাদের দেশের শ্রম আইনের ধারা ১৫১ এবং তপশীল ৫ সংশোধন করা জরুরি, যাতে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।

আইএলও কনভেনশন ১২১ কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ও পেশাগত রোগজনিত ক্ষতির জন্য শ্রমিকদের সুরক্ষা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে। এর আওতায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা, অস্থায়ী বা স্থায়ী অক্ষমতার জন্য আর্থিক সহায়তা, মৃত্যুর ক্ষেত্রে নির্ভরশীলদের ক্ষতিপূরণ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যয় প্রদান করা হয়। এছাড়া পুনর্বাসন ও পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত। ক্ষতিপূরণের হার যেন উপযুক্ত হয় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী সমন্বয়যোগ্য হয় তা কনভেনশনে বলা হয়েছে। শ্রমিকদের আপিলের অধিকার এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় আর্গোনোমিক্সের ভূমিকা

অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে বা একই ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়, সেক্ষেত্রে আর্গোনোমিক্স (অথবা কাজের পরিবেশ ও উপকরণের সঙ্গে মানুষের শারীরিক সুবিধা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আর্গোনোমিক ডিজাইনের গুরুত্ব অপরিসীম, এটি শ্রমিকদের শারীরিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং দুর্ঘটনার হারও কমিয়ে আনে। যেমন, যথাযথ চেয়ারের ডিজাইন, কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত আলো, শব্দ এবং তাপমাত্রার পরিমাপ নিশ্চিত করলে, শ্রমিকদের পেশাগত অসুস্থতা এবং আঘাতের ঝুঁকি কমে যায়। এটি শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষা করতে অত্যন্ত জরুরি।

উপসংহার

নিরাপদ কর্মক্ষেত্র কেবল শ্রমিকের জীবন নিরাপদ করে না, বরং শ্রমিকের আত্মবিশ্বাস ও উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে কারখানাকে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পথে ধাবিত করে। যখন শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে, তখন তাদের কাজের প্রতি আগ্রহ এবং মনোযোগ বাড়ে, যা তাদের উৎপাদনশীলতা ও কর্মক্ষমতাকে অনেকাংশে উন্নত করে। একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশের ফলে কাজের প্রতি শ্রমিকের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ত্রুটি ও দুর্ঘটনা কমে আসে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবসের গুরুত্ব শুধু স্মরণে সীমাবদ্ধ না রেখে, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। একসাথে কাজ করে যদি আমরা একটি নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত হবে ঝুঁকিমুক্ত এবং উৎপাদনশীল।

লেখক : বিলসডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্র্যান্ডের ভবিষ্যৎ পথ : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, টেকসইতা ও নৈতিকতা
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল