জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৩৩ বছর পর এই নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ডাকসু নির্বাচন করা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ছাত্রলীগ এতে ভালো করতে না পারায় সেই থেকে আবার নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর দীর্ঘ ৩৫ বছর আর নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়েছেন তারা জানেন না বা দেখার সুযোগ হয়নি ছাত্র সংসদের কার্যক্রম। চবির নতুন উপাচার্য সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নির্মোহ লেখালেখি করেন। তিনিও চাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। শিক্ষাঙ্গনের জন্য ভালো খবর এটি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দীর্ঘ সময়কাল ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার বা তাদের অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার কোনো বৈধ নেতৃত্ব ছিল না। যখন যে দল রাষ্টীয় ক্ষমতায় ছিল তাদের ছাত্র সংগঠন তখন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে রামরাজত্ব কায়েম করেছে। পাঠকরা সবই অবগত বলে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার অবকাশ আছে বলে মনে করি না।
নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়ে আসত এই দীর্ঘ সময়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকেই অনেক নেতা তৈরি হত, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। জাবি এবং ঢাবি ও চবিতে নতুন ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই অচলায়তন ভাঙার লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ হলেও তা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ কতটুকু সফল হতে পারবেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না। গত ষোল বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দোর্দন্ড প্রতাপ এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর দমনপীড়নের কাহিনি সবার জানা। সেই কারণটাই আমার মত অনেকের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাইলেও বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন তা এই মুহূর্তে চায় না। তারা জাতীয় নির্বাচনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নির্বাচন করার কথা ভাবছে। একইভাবে এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইলেও বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলসমূহ তা চায় না। তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, যারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় তারা পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন চায়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ যারা আগে ছাত্র সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় তারা মনে করছে এটাই উপযুক্ত সময় সরকারি দলের প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন করার। এতে সত্যিকারের জনমতের প্রতিফলন হবে। ভালো লোক যারা মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের পাশে থাকে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রভাবমুক্ত নির্বাচনে জিতে আসতে পারবেন। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হলে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। যে দল আগামীতে সরকার গঠন করবে তারা পতিত আওয়ামী লীগের গত ষোল বছরে দেখানো পথেই হাঁটবে। যে কোনোভাবে সকল স্থানীয় সরকারে নিজেদের লোক বসিয়ে সারাদেশে আধিপত্য বিস্তারের কথা ভাববে।
দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ অন্তর্র্বর্তী সরকার ভেঙে দেয়ার পর সরকারি কর্মকর্তাদের সেখানে প্রশাসক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রুটিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক সেবাপ্রাপ্তি চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদসমূহ ভেঙে না দিলেও দেশের অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় তৃণমূলের মানুষের দুর্ভোগ আরো বেশি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ আমলে মানুষ তাদের পছন্দের মানুষকে নির্বাচিত করতে পারেননি। স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিয়ে সরকারি দল যাদের মনোনয়ন দিয়েছে তারাই নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য কারো সেখানে নির্বাচিত হওয়ার পথ বন্ধ ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের রাতেই ভোট নেওয়া হয়ে গেছে। রাউজানে সেই ভোট–ভোট খেলারও অবকাশ ছিল না। স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী যাদের মনোনয়ন দিতেন তাদের বাইরে আর কারো পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার কথা ভাবা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। ফলে এই উপজেলার সব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।
যারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় তারা অতীতের এসব ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেজন্যই এই দাবিকে গুরুত্ব দিলেও বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা জাতীয় নির্বাচন ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে রাজী না। তাদের দাবি বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্র্বর্তী সরকার হিমশিম খাচ্ছে। পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে না বা তাদের মনোবল কোনোভাবেই চাঙা করা যাচ্ছে না। এই সময়ে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মত বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় তাহলে সারাদেশে নৈরাজ্য আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যতক্ষণ নির্বাচিত সরকার দেশের দায়িত্ব না নেবে ততক্ষণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে না।
ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাস কাল অতিক্রম হতে চলল। এরমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপ নিলে ছাত্রদের পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তিসমূহ এতে যোগ দিলে তা ছাত্রজনতার এই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়। নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা জনতার হিরো হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণও কার্যত তাদের হাতে ছিল। ৫ আগস্টের পর তিনদিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হলে সেই সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরে তা তিনজন হয়। ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা নিজেরা এনসিপি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে সেই দলের আহবায়কের দায়িত্ব নেন। সরকারের কেবিনেটে এখনো ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি রয়েছেন। কিন্তু ক‘মাস আগেও যে প্রভাব প্রতিপত্তি তাদের ছিল এখন তা আর নেই। ছাত্র সমন্বয়কদের অনেকে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে। তাদের সহযোগী দলসমূহও একই অবস্থান নিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের নতুন দল এনসিপি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন এবং এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে। তারা সংসদ নির্বাচনের সাথে গণপরিষদের নির্বাচনও দাবি করছে। গণপরিষদ নিয়ে মানুষের মনে খটকা আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলের ছিল না, এটা ছিল জনযুদ্ধ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে যারা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য ( এমএনএ/এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের নিয়েই স্বাধীনতার পর গঠিত হয়েছিল গণপরিষদ। এই গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পর বিলুপ্ত করা হয়। এনসিপি আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় সংসদ ও গণপরিষদ নির্বাচন একই দিনে করার দাবিতে যে জোরালো অবস্থান নিয়েছে সেটা দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরতে হবে তাদেরকে। বর্তমান সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন সংবিধানের কথা তারা বলছে, বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনের পক্ষে মত দিলেও বাতিলের দাবিকে সমর্থন করছে না। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিসমূহের মধ্যে মতভেদ দেখা দিচ্ছে এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগও উত্থাপিত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার আশ্বস্ত করছেন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গতমাসে কাতার সফরকালে তিনি আল–জাজিরা টেলিভিশনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দেশের মানুষ এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। এখনও মানুষ মনে করে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারই ভালো সমাধান। কেউ, বলছে না, এই সরকার চলে যাক, আজই নির্বাচন হোক।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বিএনপিসহ ৫০টি দল ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন চায়। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে। কোনো ‘মহামানব’ এর প্রতিষ্ঠার জন্য নয়।’
নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ে অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাবতীয় প্রস্তুতি কমিশন গ্রহণ করছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কমিশনের ভাবনায় এই মুহূর্তে নেই।
এনসিপি এবার নির্বাচন কমিশন নিয়েও মুখ খুলেছে। এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক সরোয়ার তুষার বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য একটি বিশেষ দলের সাথে মিলে যাচ্ছে। তারা একটি বিশেষ দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার আয়োজন করছে বলে মনে হয়।’
এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম ক‘দিন আগে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উপ সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রশাসন অনেক জায়গায় বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। যেসব জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি চলছে সেসব জায়গায়ও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, পুলিশ নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার, বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচন– এই তিন পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই নির্বাচনে এনসিপি অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটাও বিবেচনায় থাকবে।’
বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দাবিতে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। তারা স্থানীয় সরকার বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। দ্রুত জাতীয় নির্বাচনকেই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দলের অবস্থান তার বিপরীতে। ফলে জাতীয় নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় সরকার বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন–এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে ডাকসু, চাকসু, জাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগের সফলতা নিয়েও সংশয় থেকে যায়।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট