আমাদের বাংলাদেশে এমন কোনো দিন নেই ‘দিবস’ হিসেবে উদযাপন হয় না। সেহিসেবে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ছড়াকাররা ঠিক করেছেন একটা দিন ‘ছড়া দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার। কোন্ দিন হতে পারে সেই ছড়া দিবস? সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যের ক্ষেত্রে যাঁর কোনো তুলনা হতে পারে না, তাঁর জন্মদিনে এই ছড়া দিবস উদযাপিত হতে পারে। ছড়াকাররা ভেবেছেন ৫ জানুয়ারি সুকুমার বড়ুয়ার জন্মদিনে ‘ছড়া দিবস’ উদযাপিত হতে পারে। ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো এ দিবস উদযাপন করা হয়েছিলো চট্টগ্রামে। সেই সময়ে তাঁরা দেশ–বিদেশের ছড়াকারদের দিবসটি পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি স্থানে ২০২৫ থেকে আরও বিভিন্ন সংগঠন এই দিবস উদযাপন করবে বলে জানা গেছে। ইতিহাসের অনেককিছুর শুরু চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ছড়াসাহিত্যিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি জাতীয় ছড়া দিবস পালন করবে।
সুকুমার বড়ুয়ার জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি। তিনি আমার প্রিয় ছড়াসাহিত্যিক। তাঁর ছড়া পড়ে আমি মুগ্ধ হই, আনন্দিত হই, উচ্ছ্বসিত হই। প্রায় প্রতিটি ছড়াই আকর্ষণীয় ও স্বতঃস্ফূর্ত। একবার পড়লে বারবার পড়ার স্পৃহা জাগে, মুখস্ত হয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে মগজের ভেতর গুন গুন করে ফেরে ছড়ার বিভিন্ন পংক্তি। ফলে আড্ডায়, আসরে উপস্থাপিত হয় তাঁর বহু ছড়া।
বাংলাদেশের যে অল্প ক’জন লেখক শুধু ছড়াসাহিত্য চর্চা করে বর্তমানে খ্যাতির শিখরে যারা অবস্থান করছেন তাঁদের মধ্যে সুকুমার বড়ুয়া অন্যতম। বিষয়ের অভিনবত্বে এবং প্রকাশভঙ্গির সাবলীলতায় তিনি এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছড়াসাহিত্যিক।
সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার প্রধান আকর্ষণীয় দিক ‘ছন্দ’। ছন্দের ঝংকারে তাঁর ছড়ার প্রতিটি শব্দ যেন নেচে ওঠে। সুরের মোহজালে আটকে পড়া ছড়াগুলো শোনামাত্রই তুষ্ট হয় আমাদের কান, উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে মন। মিটে যায় কৌতূহল ও কল্পনার উৎসুকতার দাবি। তাঁর ছড়ার মন্ত্রমুগ্ধ ছন্দে–চপল নৃত্যে–নিটোল সুরে দোলায়িত হয় আমাদের মন। আমরা মাতাল হই তাঁর ছন্দে, নেচে উঠি তার ঝংকারে। আমরা আপ্লুত হই তাঁর বক্তব্যে, অভিভূত হই তার অভিনবত্বে। যেমন :
টাকা বাবা টাকা ভাই
টাকা ছাড়া গতি নাই
টাকা বড় আপনার
আর সবই পর
ধর টাকা ধর।
ইংরেজগণ বলে, ‘টাকা ঈশ্বর’
ধর টাকা ধর টাকা ধর।
এই ছড়াটিতে যেমন সুন্দর বক্তব্য বিদ্যমান, তেমনি আছে সুরের ব্যঞ্জনা। শুধু এই ছড়া নয়, সুকুমার বড়ুয়ার প্রায় প্রতিটি ছড়াতেই আছে ধ্বনির মাধুর্যতা। অর্থ–গৌরবের সাথে ধ্বনি–সৌরভের সমন্বয় সাধনের ফলে বেরিয়ে আসে ছড়ার নিগূঢ় রহস্য।
তবে ছড়ার ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ততাই মুখ্য, অর্থের গভীরতা নয়। সুরের সাবলীলতা যতটুকু প্রয়োজন, বুদ্ধির প্রতিভা ততটুকু নয়। কিন্তু সুকুমার বড়ুয়ার ছড়াগুলো সব ধরনের বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তাঁর স্বতন্ত্রবোধ তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাঁর ছড়ার সহজিয়া রূপ তাঁকে ‘প্রিয় লেখক’ ‘প্রিয় ছড়াসাহিত্যিক’র আসনে অধিষ্ঠিত করছে। তাঁর ছড়ার বক্তব্য এমনই যে, সহজে আকর্ষণ করে পাঠককে। তাঁর ছড়ার ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার এমন যে, সহজেই সহজভাবে গ্রহণ করা যায়; মুখস্ত হয়ে যায়। তাই ক্ষণে ক্ষণে মাথার ভেতর আলোড়ন তোলে ছড়ার এক একটি মধুর ও চমৎকার স্তবক।
ধুত্তুরি ছাই!
যার কাছে যাই
সব মুখে এক কথা–নাই নাই নাই।
টিভিতে নাটক হবে ভারি অদ্ভুত
মাঝখানে হুট করে নাই বিদ্যুত
আছে নাকি মোমবাতি আর দেশলাই
এখানেও এক কথা—-নাই নাই নাই।
এ ছড়াটিতে একটা সাধারণ বক্তব্যকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুন্দর উপস্থাপনা নির্ভুল ছন্দের দ্যোতনায় ছড়াটি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম। এ রকম বহু ছড়ার উদাহরণ দেয়া যায়।
২.
সুকুমার বড়ুয়া এক অসাধারণ প্রতিভা। অনেকের ভাষায় ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’। আসলে ‘লেখালেখি’ জিনিসটাই এমন, ইচ্ছে করলেই এ অঙ্গনে সফল হওয়া যায় না। চেষ্টায় হয়তো পাহাড়ে ওঠা সম্ভব, কিন্তু প্রতিভা না থাকলে শত চেষ্টা করেও লেখক হওয়া যায় না। তাই একজন লেখকের প্রয়োজন ‘কষ্ট করার মানসিকতা’ ও ‘প্রতিভা’ –দুটোই।
সুকুমার বড়ুয়ার আচরণ এতো সহজ এবং চলাফেরা এতো সাধারণ যে, তাঁকে দেখে মনে হয় না– তিনি কতো বড়ো প্রতিভাবান মানুষ। আমার মনে হয়, তিনি নিজেও জানেন না যে, তাঁর প্রতিভার ওজন কতটুকু। তিনি আমাদের ছড়া–সাহিত্যে একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। লুৎফর রহমান রিটনের ভাষায়-‘সুকুমার বড়ুয়া নামটি আমাদের গৌরব। আমাদের অহংকার।’
৩.
সুকুমার বড়ুয়া সব ছন্দে লেখেন, সব ছন্দে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। ছন্দের সাথেই তাঁর বসবাস। দিনে রাতে তিনি খেলা করেন ছন্দ নিয়ে। তাই ছন্দের ইশকুলে কখনো শিক্ষার্থী হিসেবে না থাকলেও এখন আছেন অস্তিত্ব হয়ে।
সুকমার বড়ুয়া যুৎসই ও চমকদার অন্ত্যমিল প্রয়োগে একজন দক্ষ শিল্পী। অনুপ্রাস ও মধ্যমিলের বেলায়ও তিনি অনন্য।
শেয়াল নাকি লোভ করে না
পরের কোনো জিনিসটার
কী পরিচয় দিলো আহা
কি সততা কি নিষ্ঠার!
তাই সে হলো বনের মাঝে
এডুকেশন মিনিষ্টার।
জিনিসটার, কি নিষ্ঠার, মিনিস্টার– অন্ত্যমিল শুধু চমৎকারই নয়, অকল্পনীয়ও।
গরমা গরম! গরমা গরম
ছাপাখানার ফর্মা গরম,
বেতার টিভি খবর দিল
জাপান মিশর বর্মা গরম
এমন কথা শুনতে পেয়ে
বিণয়ভূষণ শর্মা গরম।
এ ধরনের অন্ত্যমিলের জন্য তিনি আমাদের অনুকরণীয় শিল্পী।
রাস বিহারী দাসের নাতি
হাসপাতালে বাস করে
মাস পুরোলেই দেশে গিয়ে
খাস জমিতে চাষ করে।
পাশ করেনি পরীক্ষাতে
পয়সা কড়ি নাশ করে
হাতের কাছে কাউকে পেলে
চড়া মেরে দেয় ঠাস করে।
শুধু অন্ত্যমিল নয়, মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের জন্যও ছড়াটি অসাধারণ।
৪.
একেবারে শিশু বয়সে বাবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় অভাবগ্রস্ত সংসারে হাল ধরতে হয়েছিল সুকুমার বড়ুয়াকে। ফলে শৈশবে নেমে পড়তে হয়েছিল রোজগারে। ১৯৫০ সালের ১ জুন তিনি তাঁর প্রথম নাম লেখান শিশুশ্রমিকের খাতায়। সুকুমার বড়ুয়া নিজেই বলেন-“আমার প্রথম চাকরি চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাবু মনোমহন তালুকদারের বাসায়। প্রথম কাজ হলো একটি ৫ মাসের শিশুকে সঙ্গ দেয়া। মাসিক বেতন তিন টাকা। সেই শিশুটি পরবর্তী সময়ে চিত্র পরিচালক চঞ্চল বড়ুয়া (ঘর ভাঙ্গাঘর)। সেই পরিবারে এসেই পেলাম কিছু উন্নত শ্রেণীর রুচিশীল মানুষ। কর্তাবাবু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও বেশ স্নেহপ্রবণ, গৃহকর্তী মাসীমা আপন সন্তানের চেয়ে কম স্নেহ করেন না। শিক্ষিত ছেলে–মেয়েরা নাচ, গান, নাটক ইত্যাদি করে। আপন ভাইবোনের মতো সম্পর্ক। কারো মনে থাকে না আমি পরিবারের কে? ১৯৫২ সালে আমার এক মামতো ভাইয়ের সাথে চলে এলাম ভৈরব বাজার। কাজ দু’জনের রান্না করা। বেতন ৫ টাকা। চট্টগ্রামের চেয়ে এখানে দু’টাকা বেশি।” এভাবে অতিবাহিত হতে থাকে সুকুমার বড়ুয়া’র সুবর্ণ শৈশব–কৈশোর। বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁকে ছোটোবেলাতেই অনেক কিছু করতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন কষ্ট।
একজন ভালো ছাত্র হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। আর্থিক অনটনের কারণে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষা তাঁর দেয়া হয় নি। তিনি বলেন-‘মাত্র আড়াই ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি আমি’। সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত সুকুমার বড়ুয়া তাঁর স্কুল জীবন সম্পর্কে বলেন-“আমি যে প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, সেই স্কুলে একদিন আসবেন ইন্সপেক্টর। মহেশ মাস্টার, রমণী মাস্টার আর সুশীল মাস্টার; এই তিনজন ভালো সেজেগুজে এসেছেন। গ্রামের শিক্ষার্থীদের যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া হলো। যথাসময়ে এক দাঁড়িওয়ালা স্পষ্টভাষী ইন্সপেক্টর এলেন। ছাত্রদের বুদ্ধিশুদ্ধি পরীক্ষা হবে। ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির সাথে কিছু হাই স্কুলের বড় বড় ছেলেকে ভেজাল দিয়ে দাঁড় করানো হলো লাইন ধরে। ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন-‘বুদ্ধি ধরো বুদ্ধি ধরো!’ সবাই হাঁ–করে আছে! বুঝলে না? দু’হাত এক করে পতাকা ধরার মতো মুষ্টিবদ্ধ করো। লাইনে আট–দশ ছেলে হবে ঐ দলের সাথে আমাকেও দাঁড় করানো হলো। কিছু মানষাঙ্ক ধরলেন। মানষাঙ্ক মানে–মনে মনে সমাধান করা। প্রথমে কয়েকটি আমি আগে বলতে পারি নি, পরে বেশ কয়েকটি আমি আগেই পেরেছি। তাঁর শেষ অংকটি ছিল ৩১–১৭= কত? চট করে বললাম ১৪। ইন্সপেক্টর সাহেব দারুণ খুশিতে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। এর পরের অংকটি শ্লেটে করতে হবে বিশেষ কায়দায়। সবাইকে দাঁড় করানো হলো, যাতে একজনেরটা অন্যরা না দেখতে পায়। হুকুম দিলেন লেখ–
এগারো হাজার এগারো,
তাকে এগারো দিয়ে ভাগ করো।
অনেকে ১১০১১ লিখতেই পারে নি। আমার এবং আরেকজন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রের ফলাফল হয়েছে ১০১। সবার অংক ভুল হলে ইন্সপেক্টর সাহেব আমার খুব তারিফ করলেন। কিনতু সে স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর পড়া আমার শেষ হয় নি!
স্কুল থেকে পরীক্ষার ফি মাপ করবেন বলে হেড মাষ্টার সুশীল বাবু জানালেও বড় দিদি আমাকে পরীক্ষা দিতে দেয় নি। স্কুলে যাওয়ার সময় বাধা দিয়ে বললেন–যাও গরু–ছাগল দেখো পড়তে হবে না। বাংলাদেশে এমনি কত লক্ষ কিশোরের ভাগ্যে এমন ঘটেছে কে জানে!”
৫.
সুকুমার বড়ুয়া বাংলাদেশের অনেক তরুণের আদর্শের ‘ছড়াশিল্পী’। তাঁর সহজাত প্রকাশ–নৈপুণ্যে, শব্দ–কুশলতায় ও সুরের ব্যঞ্জনায় তাঁর ছড়া যেমন হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী, তেমনি তিনি হয়ে উঠেছেন ‘প্রিয়’।
সেই জীবন্ত কিংবদন্তি সুকুমার বড়ুয়ার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এবারের ছড়া দিবসের কর্মসূচিতে থাকছে সেমিনার, ছড়া পাঠ ও আবৃত্তি। ৫ জানুয়ারি রোববার বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা। স্থান : ফয়েজ নুরনাহার মিলনায়তন, চট্টগ্রাম একাডেমি, কদমমোবারক বাইলেইন, চট্টগ্রাম। আমরা এ দিবসের সফলতা কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।