জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্যের বিকল্প নেই

নাসের রহমান | বুধবার , ৪ জুন, ২০২৫ at ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ

ঐকমত্যে পৌঁছা বা ঐক্যবদ্ধ হওয়া এক কথা নয়। কোন একটি বিষয়ে সহজে ঐক্যমতে পৌঁছা যায়। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়া এতো সহজ নয়। আলাপ আলোচনা যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা যায়। জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যেগুলোর সিদ্ধান্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিতে হয়। এসব বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও ঐকমত্য তৈরী হলে লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ নয়। যে কোনো বিষয়ে সবাই যে একমতে আসবে তা নয়। কারো মতের ভিন্নতা থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি সবার সমর্থণ থাকা প্রয়োজন। ঐকমত্য তখনই গড়ে ওঠে যখন ভিন্নমতের যারা তারাও একাত্মতা ঘোষণা করে। অর্থাৎ কোন বিষয়ে ঐকমত্যের ব্যাপারে কারো কারো আপত্তি থাকলে বা কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেও কেউ যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে। তা না হলে ঐকমত্যের জায়গাটা সুদৃঢ় থাকে না। পারস্পরিক সহ অবস্থানটাও নড়েবড়ে হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে অনাস্থারও আশংকা দেখা দেয়। এমনকি ঐক্যে ফাটল ধরার ঝুঁকিও তৈরি হয়। এতে করে ঐক্যের মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনা তৈরি হয় তা আর অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ঐকমত্যের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে যখন নির্বাচিত সরকার থাকে না, সংসদ থাকে না। যেসব বিষয়ে সংসদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এরকম বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ঐকমত্যের বিকল্প থাকে না। জাতীয় ইস্যুগুলোতে জনগণের সম্মতি বা মতামত আছে কিনা তা যাচাই করা সহজ নয়। গণভোটের মাধ্যমে সঠিক ফলাফল আশা করা যায় না। এসব বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করাও কোন সহজ ব্যাপার নয়। ফলে সংসদ ছাড়া জনমত যাচাই করার বিকল্প কোন পন্থা নেই। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ঐক্যমত গড়ে তোলা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও জাতীয় ইস্যুতে তারা অভিন্ন মতামত প্রদান করতে পারে। সামরিক সরকার ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের সরকারকে জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হয়। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না এমন কাজ করলে তা কখনো জনগন গ্রহণ করে না। যতই জনপ্রিয় সরকার হোক না কেন জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করলে একসময়ে না একসময়ে সরকার জনগন দ্বারা বিতাড়িত হয়। এমনকি সামরিক সরকারও বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না।

গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে তার ওপর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রথম দিকে এ ধরনের সরকার জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকে। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কাজ করে যায়। কিন্তু এসব সরকারের অনেক রকম সীমাবদ্ধতা থাকে। বিশেষ করে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। সরকার জনগণের আস্থাভাজন হলেও যারা দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা তারা পায় না। ফলে জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পুরাপরি বাস্তবায়িত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতায় আটকে পড়ে থাকে। কোন কোন সময় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও জটিলতার সৃৃষ্টি হয়। এমনকি অচলবস্থারও মুখামুখি দাঁড়াতে হয়। যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। সরকারের প্রতি জনসমর্থন থাকলেও জনভিত্তি গড়ে ওঠে না। সরকারকে সম্পূর্ণরূপপে আমলানির্ভর হয়ে কাজ করতে হয়। সরকারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে প্রশাসনের লোকেরা সরাসরি সরকারের কর্মকান্ডগুলো পরিচালিত করে থাকে। এতে করে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির অসন্তুষ্ঠি মানুষের মনে বিরূপ সমালোচনার ঝড় তোলে। সরকারের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। সরকারও বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে চায়। মানুষের ভরসার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে আসে। আস্থায়ও ফাটল ধরে। অনেক সময় জনপ্রিয় সরকারকেও আস্থার সংকটে পড়তে হয়। যা একটা সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডে অন্তরায় হয়ে যায়।

জাতীয় বিষয় নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার উদাহরণ প্রায় লক্ষ্য করা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে যে ঐক্যমত হয় তা নয়। সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলেও আলাপ আলোচনায় একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারে। যে কোনো পক্ষের সহমত ভিন্নমত থাকতে পারে। সবার মতামতকে এক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য আলোচনার প্রয়োজন হয়। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে ঐকমত্যের জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ বিষয়ে তারা অবগত নয় কিংবা তাদের সাথে আলাপ হয়নি একথা বলার সুযোগ থাকে না। এজন্য সকল পক্ষের সাথে মত বিনিময়ের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা এলেও উপেক্ষা করা যায়। কারণ ঐকমত্যের ভেতরেও আবার ভিন্নমত থাকতে পারে। কোন একটি পক্ষের বিশেষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হতে পারে। আবার ঐক্যমত দীর্ঘ সময় ধরে নাও থাকতে পারে। এজন্য যে বিষয়ে ঐম্যমতে পৌঁছা যায় তার সিদ্ধান্ত দ্রততার সাথে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে হয়। এমনও কিছু বিষয় আছে যার সাথে অনেক কিছু সম্পর্কিত। এসব সম্পর্কিত বিষয়ে আগাম ধারণা পাওয়াও কঠিন। কোন কোন ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় পুরো পরিকল্পনাটা বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কোনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন।

কোনো জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিরল। অনেক বৎসর অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি যুগের পর যুগ অপেক্ষা করে জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। তাও আবার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তখন জাতি পুরোপুরিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এ ঐক্য জাতিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস যুগিয়েছিল। জাতি মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। সেদিন ঐক্যবদ্ধ জাতিকে আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। এ ধরনের বড় অর্জনে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। ঐক্যবদ্ধ না হলে এতো বড় গৌরবময় অর্জন কখনো জাতির ভাগ্যে আসতো না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ অর্জন। যা এ জাতিকে বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদাশীল করেছে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটেছে। এমন ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় ঐক্য জাতির মাঝে আগেও কখনো দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পরও জাতি আর কোন সময়ে এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়নি।

চব্বিশের ছাত্রজনতার আন্দোলনের শেষের দিকে জাতির মধ্যে এক ধরনের ঐক্যবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন যখন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এর আগে বা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কেউ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য বলেনি। তারপরও মানুষ নিজের বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনে শরীক হয়েছে। স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়েনি। তবে এ ঐক্যটি বেশিদিন টিকেনি। কয়েক নিদের মধ্যে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ঠিক সেভাবে কয়েক মাসের মধ্যে ঐক্যটা আবার ছুটে গিয়েছে। ঐক্য ধরে রাখার জন্য যে নেতৃত্বের প্রয়োজন তা গড়ে ওঠেনি। সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। যারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাদের মাঝে আবার পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হয়ে গিয়েছে। আসলে যে কারণে ঐক্য হয়েছিল ‘স্বৈরাচারের পতন’ তা নিশ্চিত হওয়ার পর ঐক্য সেভাবে অটুট থাকেনি। মুখে মুখে ঐক্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা টিকে থাকেনি। লক্ষ্য নির্ধারণেও মত পার্থক্য দেখা দেয়। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবার মাঝে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। ফলে স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সাধারণ মানুষকে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি। এজন্য ঐক্যের সুফল স্বৈরাচার পতন পর্যণ্ত গিয়ে আটকে যায়। এর পর থেকে ঐক্যের অন্তরালে অনৈক্যের সুর বাজে বেশি। যা কখনো জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা, প্রতিকার ও একাডেমিক উন্নয়ন
পরবর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান