জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি, বেতন দিতে তহবিল গঠনের সুপারিশ

শ্রম সংস্কার কমিশন

| মঙ্গলবার , ২২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

সব খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইনকে ‘সর্বজনীন’ করার পাশাপাশি শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা দিতে জাতীয়ভাবে একটি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে শ্রম অসন্তোষ দূর করতে রপ্তানি খাতের শিল্পের শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন পরিশোধ করার মত অর্থ নিয়ে একটি তহবিল গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ নেতৃত্বাধীন এই কমিশন গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

পরে বিকালে রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন সুলতান উদ্দিন আহমেদ। খবর বিডিনিউজের।

তিনি বলেন, দেশে বেশিরভাগ শ্রমিকের স্বীকৃতি নেই। সেজন্য আমরা সর্বজনীন শ্রমিক অধিকারের কথা বলেছি। সব খাতের শ্রমিকের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। দেশের রপ্তানি খাতের পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পে শ্রমিকদের নানা বঞ্চনার সংবাদ প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের মজুরি নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন, অবরোধ, ভাংচুরের ঘটনা প্রায়ই ঘটে, যার মূল কারণ বকেয়া বেতন বা মজুরি নিয়ে অসন্তোষ। সংস্কার কমিশন শ্রম অসন্তোষ ঠেকাতে যথা সময়ে মজুরি পরিশোধ করার ওপর জোর দিচ্ছে। যেসব কারখানা মজুরি দিতে দেরি করবে, সেসব কারখানার উদ্যোক্তাদের দৈনিক জরিমানা করা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জরুরি পরিস্থিতি, রপ্তানি আয় যথা সময়ে দেশে না আসা বা কারখানা বন্ধ হওয়ার মত পরিস্থিতিতেও সময়মত মজুরি পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে একটি

তহবিল গঠন করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের দুই মাসের বেতনের সম পরিমাণ অর্থ এ তহবিলে জমা রাখবেন উদ্যোক্তরা। উদ্যোক্তা, শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারের প্রতিনিধি মিলে এ তহবিল পরিচালিত হবে। উদ্যোক্তা বা প্রয়োজনে সরকার চাইলে এ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে মজুরি পরিশোধ করতে পারবে। এ বিষয়ে সুলতান উদ্দিন বলেন, এখানে (রপ্তানি খাত) শ্রমিকদের বকেয়া বেতনভাতার প্রশ্নটি আসে। এখানে হঠাৎ করেই রপ্তানি বন্ধ বা টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত ঝুঁকিটা থাকে। প্রতি জেলায় একজন করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব রয়েছে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, শ্রম আইনে শিল্পের উদ্যোক্তাদের ‘মালিক’ এর বদলে ‘নিয়োগ কর্তা’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোনো শ্রমিককে এক দিনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলেও চুক্তিপত্র বা পরিচয়পত্র থাকতে হবে। সব খাতের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে শ্রম আইন ‘সর্বজনীন’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সারা দেশের শ্রমিকদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার গঠনের কথা বলেছে কমিশন।

সুলতান উদ্দিন বলেন, সেবা খাতে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে স্বউদ্যোগে নিয়োজিতরা তথ্য ভাণ্ডারের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করবে। এই নিবন্ধনই শ্রমিক হিসেবে তার পরিচয়পত্র হবে। মৎস্যজীবী, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক ও হকারের মত স্বাধীন শ্রমজীবীদের এভাবে নিবন্ধন করে পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করছে কমিশন। বতর্মানে কোনো শিল্পের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাইলে মোট শ্রমিকদের মধ্যে একটি আনুপাতের সমর্থন প্রয়োজন হয়। কমিশন সেখানে আনুপাতিক হারের বদলে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের সমর্থন পেলেই ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের দরকষাকষির প্রক্রিয়া যেন আরও সহজ হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সুলতান আহমেদ বলেন, দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন। তার মধ্যে বেশিরভাগেরই আইনি সুরক্ষা নেই। সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই জাতীয়ভাবে একটি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। শ্রম আইনে ‘মহিলা’ শব্দের বদলে ‘নারী’ শব্দটি ব্যবহার করতে বলেছে কমিশন। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দূর করতে ২০০৯ সালের হাই কোর্টের নির্দেশনার আলোকে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সামপ্রতিক শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

সুলতান আহমেদ জানান, পাঁচ মাস ধরে সারা দেশে শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ছোটো ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ৪৫৮ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তারা দিয়েছেন। চারটি ভাগে দেওয়া প্রতিবেদনে ২৫টি মৌলিক সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিভাগে ডেঙ্গুতে আরও এক মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে এসে নিখোঁজ সিলেটের ৬ যুবক