জনাব স্পিকারঃ এই সংসদ গভীর দুঃখ ও সমবেদনার সহিত প্রস্তাব করিতেছে যে, জাতীয় সংসদ সদস্য ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ বিভাগীয় মন্ত্রী জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন একনিষ্ঠ সমাজসেবী, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, শ্রমিক নেতা, অকুতোভয় দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীকে হারাইয়াছে। এই সংসদ তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করিতেছে এবং তাঁহার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী): জনাব স্পিকার, আজ সকাল ৬ টা ৪৫ মিনিটে পি.জি. হাসপাতালে আমাদের সহকর্মী, বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলহাজ্ব জহুর আহমদ চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন। দীর্ঘ ৩১ বছর তিনি আমার পাশে ও সাথে সাথে ছিলেন। আমরা একসাথে, একযোগে এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছি। অনেক কথা মনে পড়ে । ১৯৪৩ সালে তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি, তখন জহুর আহমদ চৌধুরীর মত এম. এ. আজিজও আমার সাথে ছিলেন। একদিনের জন্যও তিনি এ দেশের জনসাধারণ এবং তাদের ন্যায্য দাবির সংগ্রাম থেকে দূরে সরে দাঁড়ান নাই। আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁকে আপনারা এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বলতে পারেন। অনেকবার কারাবরণ করেছেন তিনি। তিনি প্রায় ৮ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। অনেক মামলার আসামিও তাঁকে হতে হয়েছিল ।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়ার পরে আমরা যখন গ্রেফতার হই, তখন তিনিও গ্রেফতার হন, গ্রেফতারের পরে সিলেট জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তারপরে তার ওপর নির্যাতন করা হয়। তার একটা কান বধির ছিল। এ হাউসের অনেকেই হয়তো জানেন না যে, তাঁর ওপর সেই সময় যে অত্যাচার করা হয়েছিল, নির্যাতন চালান হয়েছিল, তার ফলেই কানে যে আঘাত লাগে, তাতে তাঁর একটা কান বধির হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের আন্দোলনের পরে যে অমানুষিক অত্যাচার সিলেট জেলে তার ওপর হয়েছিল, তাতে কান বধির হয়ে গিয়েছিল। এমন কোন আন্দোলন নাই, যে আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না। তাঁকে চট্টগ্রামে শ্রমিক আন্দোলনের পিতা বলা হতো। শ্রমিক আন্দোলন কি জিনিস, শ্রমিকের হৃদয় কিভাবে জয় করতে হয়, তা তিনি চট্টগ্রামে দেখিয়ে দিয়েছেন।
তিনি খুবই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং সাধারণ মানুষের মত বাস করতেন। সমস্ত দিন–রাত তিনি কৃষকের সাথে, শ্রমিকের সাথে, দুঃখী মানুষের সাথে থাকতেন। তাঁর একটা গুণের ইতিহাস আছে। তিনি যা কিছু উপার্জন করতেন তা গরিবদের খাইয়ে দিতেন। আজকাল এটা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে, মন্ত্রী হলেই তাঁর ওপর বদনামী এসে যায়।
আজ এটা প্রমাণ হয়ে যাক। দেখুক বাংলাদেশের মানুষ যে, মন্ত্রী হলেই তাঁর বদনাম হয় না।
আজ জহুর আহমদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে দেখুক, তাঁর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই । তারা খোঁজ করে দেখুক জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলেপিলের খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নাই। এটা আজকাল আমাদের দেশের একটা ফ্যাশন যে, আমরা নিজেদের সমালোচনা করে নিজেদের সর্বনাশ করি। দেখুন তার ছেলেপিলের দিকে তাকিয়ে। কি করে যে তারা বাঁচবে, সে চিন্তা করতে আমরা ভয় পাই। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয় এবং তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বাড়িতে তাঁর যে কর্মঠ ছেলে ছিল সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় রাঙ্গুনিয়াতে । কারণ সে তখন আমার মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খাবার সাপ্লাই করছিল। সে জন্য সে সময় তাকে রাস্তায় হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আগরতলায় একটা স্কুল ঘরে বসে এই অঞ্চলের ভার তিনি গ্রহণ করেন এবং সেখানে বসে তিনি তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। কী হয়েছে জানিনা, কিছুদিনের মধ্যে অনেক সহকর্মীকে হারাতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে হাজার হাজার কর্মী ও নেতাকে। হারাতে হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মীকে। স্বাধীনতার পরে অনেকে জীবন দিয়েছে। অনেকের এমনি সাধারণভাবে মৃত্যু হয়েছে, অনেককে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রতিমন্ত্রী মিসেস বদরুন্নেছা আহমেদ ইন্তেকাল করলেন, চট্টগ্রামের ‘লিডার হান্নান সাহেব ইন্তেকাল করলেন‘। আজ জহুর আহমেদ চৌধুরী ইন্তেকাল করলেন। মানুষকে মরতে একদিন হয়। আজ অবস্থা আমার এই হয়েছে, অল্প শোকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর। আজকাল আমাদের আর কি–ইবা করার আছে, আমাদের কি–ইবা উপায় আছে, আমরা আল্লাহর কাছে মুনাজাত করতে পারি।
মাননীয় স্পিকারঃ দীর্ঘদিন দেশের জন্য তিনি সংগ্রাম করে চলে গেলেন । বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। কত যে কটূক্তি শুনতে হয়েছে এই আড়াই বছরের মন্ত্রিত্বের জন্য। জহুর আহমদ চৌধুরী কিছুই নিয়ে যাননি। কেউ কিছু নিয়ে যায় না। একদিন সকলকেই মরতে হবে। মৃত্যুটাই স্বাভাবিক।
মাননীয় স্পিকার, আজ আপনি শোক প্রস্তাব এনেছেন। অনেক শোক প্রস্তাব এই সংসদে আমাদের পাশ করতে হয়েছে। আমরা শোক প্রস্তাব পাস করে তাঁর পরিবারবর্গকে সমবেদনা জানাই, দোয়া করি, আল্লাহর কাছে মোনাজাত জানাই, তার আত্মার শান্তির জন্য।
আজকে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, জহুর আহমদ চৌধুরী আজ যে জিনিস দেখিয়ে গেছেন, যদি আমরা সকলেই তা পালন করে চলতে পারি, তাহলে এদেশের মানুষের মঙ্গল হবে। তিনি চট্টগ্রামের প্রতিটি দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সংগ্রামের সময় অনেকে ঘর থেকে বের হয়ে কথা বলতে সাহস পায়নি, তারা আজকে অনেকেই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে থাকে। তাতে আমার দুঃখ নাই। সত্য সত্যই থাকে, মিথ্যা মিথ্যাই হয়। কিছুদিন চৎড়ঢ়ধমধহফধ করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়। কিন্তু সেখানে মিথ্যা মিথ্যাই থাকে, সত্য সত্যই থাকে, একথা সকলেই জানে ।
মাননীয় স্পীকার, আপনার কাছে আমার কিছু বলার নাই। বহুদিনের সহকর্মী হারিয়েছি, আমি বড়ই ব্যথিত। বক্তৃতা করতে কষ্ট হয়, অনেক দিন বক্তৃতা করিনি, আজ বক্তৃতা করে সমবেদনা জানাবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু আজ খুব কষ্ট পেয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। একদিনও শান্তি পাননি জহুর আহমদ চৌধুরী। অনেক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পি.জি হাসপাতালের ডাক্তাররা সবাই এবং আরো অনেকেই তাঁর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মৃত্যু আল্লাহর হাতে, মৃত্যুকে কেউ রুখতে পারে না।
প্রত্যেকটি মানুষেরই যেতে হবে।
মাননীয় স্পীকার, সকলের পক্ষ থেকে আপনি যে প্রস্তাব করেছেন, তা আমি সমর্থন করি এবং আশা করি আপনি সকলকে বলবেন, দুই মিনিট দাঁড়িয়ে দোয়া করার জন্য যাতে তাঁর আত্মা শান্তি পান। তার সেই ইতিহাস যদি আমি দিতে যাই তাহলে অনেক সময় লাগবে। আমি আপানার সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার মনও অবশ্য ভাল নয়। এই জন্যই আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করছি।
জনাব স্পিকারঃ মৌলবী জালাল সাহেব, আপনি মোনাজাত পরিচালনা করবেন। আমি এই সংসদের মাননীয় সদস্য এবং সদস্যবৃন্দকে অনুরোধ করব দুই মিনিট আমরা দাঁড়িয়ে বিদেহী আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করি।
[সকলে দাঁড়িয়ে দুই মিনিট মাগফেরাৎ কামনা করেন। অতঃপর আলহাজ্জ মৌঃ জালাল আহমেদ সাহেব মোনাজাত পরিচালনা করেন। সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা মরহুমের শোক–সন্তপ্ত পরিবারবর্গের নিকট প্রেরণ করা হবে। সচিব যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ]