গত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা অভূতপূর্ব। দুর্বার ছাত্র আন্দোলন ১৫ বছরের সরকারকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ১৫ বছর নানামুখী আন্দোলন করে ও যেখানে কোন কূলকিনারা পায়নি সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি। অবশ্য সরকারের মারমুখী আচরণের কারণেও তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। ছাত্র জনতার এই জনপ্রিয় আন্দোলনে সরকার পতনের পর মানুষের মধ্যে একরকম আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেন সত্যি সত্যিই বৈষম্যবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ রাখতে পারে। তবে যা–কিছু ঘটেছে তার অনেক কিছুই প্রত্যাশিত ছিল না। বাংলাদেশের যে–কোনো রাজনৈতিক সংঘাতে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। এটা নতুন কিছু নয়। যত যাই হোক আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত কোনো শুভ লক্ষণ নয়। কোনো জাতির সভ্যতাকে ধারণ করে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। শিল্প সংস্কৃতি মানুষের মনের কালোকে দূর করে আলো জ্বালিয়ে রাখে। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা জাতিকে এগিয়ে নেয়। যে বত্রিশ নাম্বার বাড়ি ৭১–এ পোড়াতে পারেনি, ৭৫–এও নয়! আমাদের মুক্তিযুদ্বের প্রতীক সেই বাড়িটি ধ্বংস করা হল এই ২৪–এ এসে। এটা মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হয়েছে। তারা যে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করে এমন নয় কিন্তু। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত এই বাড়িটি আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তো ভেঙেছে, খুব নোংরাভাবে অপমান করেছে। এসবের সাথে ভেঙেছে রবীন্দ্রনাথের, শিল্পাচার্যের, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্যও। শিল্পকলা তছনছ করেছে, হামলা করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও। এসব কোনোভাইে শুভবার্তা বহন করে না। দেশ স্বাধীন হওয়া, আর দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করার ব্যাপারটা একই অর্থ বহন করে না। একটা স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য ২৪ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। একটু একটু করে জাতিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই ভূখণ্ড, এই পতাকার জন্য ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। তিন লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। এই দেশটাকে পোড়া মাটি করে রেখে গিয়েছিলো পাকিস্তানীরা। এ–সব ইতিহাসকে কখনো ম্লান হতে দেওয়া যায় না। যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ধ্বংস করতে তৎপর হয়েছে সেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই ২০২৪–এও একটা বড় অর্জন আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্বস্মৃতি বা ওয়ার্ল্ড মেমোরির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের লেখা নারীমুক্তির প্রতীকী উপন্যাস সুলতানা’স ড্রিম। নারী স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ এর ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। মঙ্গোলিয়ার রাজধানী বাটোরে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া এন্ড প্যাসিফিকের দশম সাধারণ সভায় এই ঘোষণাটি দেওয়া হয়। এই কমিটির কাছে সুলতানা’স ড্রিমের জন্য আবেদন জানিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরবময় অর্জন। শত বছর আগে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন অনগ্রসর নারীদের এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন থেকে। তিনি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। সমাজের সর্বস্তরে নারীরা যেন অবদান রাখতে পারে। নারীদের বিজ্ঞান শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দিয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে সুলতানা’স ড্রিম শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯০৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নারীদের ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সময়ের বাস্তবতায় এমন রচনা ছিল অসীম সাহসী ও বৈপ্লবিক। শত বছর আগের এই লেখায় যে বার্তা তিনি দিয়েছেন তা বিশ্বে সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর স্বপ্নের নারীরা এগিয়েছেন বটে কিন্তু এখনো সমাজের বৈরী মনোভাব নারীর জন্য বাধা হয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রে। খুব দুঃখের সাথে বলতে হয় এই আন্দোলনের পরে দেখা যায় তাঁর ছবিও অশ্লীল ভাষায় আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বাস করতে চাই এসব নিশ্চয়ই আমাদের ছাত্ররা করেনি। এর আগে ইউনেস্কো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু স্বৈরাচার হঠালে হবে না, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দিতে হবে নির্মোহভাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।