প্রত্যেক চলচ্চিত্রকারের একটি সিগনেচার ফিল্ম বা প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র থাকে যেটা তাঁর নামের সঙ্গে অনেকটা অঙ্গীভূত হয়ে যায়। তেমনই সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ও ঘুড্ডি। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে নানাবিধ সৃষ্টিশীল কাজে ব্যাপৃত থাকলেও এবং আরও কয়েকটি ছবি নির্মাণ করলেও ‘ঘুড্ডি’ (১৯৮০) ছবির পরিচালক হিসেবে সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংসদ আন্দোলনে সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর ভূমিকা বরাবরই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সক্রিয়। শেষ দিকে শারীরিক অসমর্থ্যতার কারণে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও অভিভাবক ও পরামর্শক হিসেবে শেষ পর্যন্ত তিনি সংযুক্ত ছিলেন। এদেশের নাট্য আন্দোলনেও তাঁর ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। নাটক ও চলচ্চিত্র উভয় আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর মতো মাত্র কয়েকজনকে পাওয়া যায় বাংলাদেশে। এবং দুক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সব্যসাচী।
সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ছিলেন প্রবীণ নবীন সকলেরই প্রিয় ‘জাকী ভাই’। অত্যন্ত অমায়িক এবং নিরহংকারী মানুষটি নিমিষেই যে কোনো কাউকে আপন করে নিতে পারতেন। চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সূত্রে অনেকবার তাঁর আন্তরিক সাহচর্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। সদাহাস্য সুদর্শন মানুষটি কখনোই নিজেকে জাহির করতেন না। অথচ রীতিমতো একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনের অগ্রজজন থেকে একেবারে নবীনতম জন পর্যন্ত সকলকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দিতে দেখেছি তাঁকে। এর বিনিময়ে তিনিও পেয়ে গেছেন অকুন্ঠ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
চলচ্চিত্র নির্দেশনায় ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করেছিলেন। সেখানে সান্নিধ্যে এসেছিলেন ভারত ও ভারতের বাইরের অনেক দিকপাল নির্মাতা ও কলাকুশলীরা যা তাঁর মেধা ও মননকে আরও শাণিত করেছে। তারও আগে পদার্থবিদ্যায় সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি যুক্ত হন চলচ্চিত্র ও নাট্য আন্দোলনে।
১৯৬৮ সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। সিনে আর্ট সার্কেলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চলচ্চিত্র সাংসদ চর্চার শুরু তাঁর। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ঢাকা থিয়েটারেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ঘুড্ডি ছবিটিকে মূল ও সহ অভিনয়ে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অভিনয় শিল্পী। কলাকুশলীদের প্রায় সকলেই ছিলেন সে সময়ের নবপ্রজন্মের। ঘুড্ডিকে যেমন বলা যায় আরবানাইজড ফিল্ম বা নাগরিক চলচ্চিত্র তেমনি এটি ছিল নতুন প্রজন্মের (সে সময়ের) সমারোহ। অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের সকলেই পরবর্তীকালে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জনে সমর্থ হয়েছেন। অনেকেরই এটি ছিল ডেবিট ফিল্ম। মজার বিষয় ছিল, অভিনয়শিল্পীরা প্রায় সবাই নাটকের হলেও ছবিতে সবাই সিনেমাটিক অভিনয় করেছিলেন। যা সম্ভব হয়েছিল পরিচালকের হাতযশে। জাকী ভাই এর পূর্বে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করলেও ঘুড্ডি ছিল তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র। সবাই মিলে অনেকটা পিকনিক মুডে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। ঘুড্ডি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত একটি চলচ্চিত্র যার কাহিনী, চিত্রনাট্য সংলাপ শিল্পনির্দেশনা ও পরিচালনা সবই সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর। তবে ছবিটির কাহিনী রেখা অবিকল মিলে যায় মৃণাল সেন পরিচালিত আকাশ কুসুম (১৯৬৫) ছবির সঙ্গে যে ছবির কাহিনীকার আশীষ বর্মন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন জাকী ভাই। উপস্থাপনা দিয়ে শুরু। সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা ছিল তাঁর। ১৯৮০–এর দশকের শেষ দিকে মৃণাল সেনের চমৎকার একটি সাক্ষাৎকার আমরা বিটিভিতে দেখেছিলাম তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায়। ১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলেরও শীর্ষ ছিলেন কিছুদিন।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায় জাকী ভাইয়ের ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁর সহজাত ছিল। সাহিত্যকর্মেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অনেক গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন পত্রপত্রিকা গ্রন্থ; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা কৌণিক, স্বপক্ষে, কাক, চলচ্চিত্র পত্রিকা চলচ্চিত্র কথা ইত্যাদি। অনুপম হায়াতের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস গ্রন্থটি রচনা ও প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি বেশ কয়েকবছর বিএফডিসির নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় বিএফডিসি থেকে।
চলচ্চিত্র শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চলচ্চিত্র সংসদের চলচ্চিত্র সমীক্ষণ কোর্সগুলিতে তাঁর প্রাঞ্জল শিক্ষণ রীতি শিক্ষার্থীদের বিমোহিত করে রাখতো। আমিও একবার সুযোগ পেয়েছিলাম এই অভিজ্ঞতার। উনার সঙ্গে কয়েকটি আলোচনা সভায়ও অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। পুরো অনুষ্ঠান উনি প্রাণবন্তভাবে উপভোগ্য করে রাখতেন।
সবকিছুর আগে ও পরে সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর ছবি–ঘুড্ডি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উল্লেখযোগ্য একটি কৃতি। ঘুড্ডির আগে তিনি ভারতে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তৈরি করে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; চিনাবাদাম ও মানিব্যাগ। দেয়াল, কাঠের কাউন্টার, একটি গান, দি বিগিনিং এবং পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি তামাশা। বাংলাদেশে বাদল রহমানের সঙ্গে প্রত্যাশার সূর্য, অংকুর, গল্পদাদুর গল্পকথা, শিল্পায়ন, মৎস্যজীবী। ঘুড্ডির পর নির্মাণ করছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র আয়নাবিবির পালা, লাল বেনারসি। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে কিছুদিন আগে শেষ করেছেন অপরাজেয় একা ও ক্রান্তিকাল ছবি দু’টির কাজ। বলেছিলেন, ‘যতদিন বেঁচে থাকবো, সিনেমা করে যাবো।’ ইচ্ছাপূরণ হয়েছে তাঁর। তবে একটা কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, ঘুড্ডিকে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। তাই অনেকেই বলেছেন, ঘুড্ডির পর তিনি আর সিনেমা তৈরি না করলে ভালো করতেন। এই ছবিটির বহুল প্রদর্শন একান্তই প্রয়োজন।
১৯৪৬ সালের ২৬ আগস্ট টাঙ্গাইল জেলার করটিয়ায় সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর জন্ম।
৭৭ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শেষে বিদায় নিলেন ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১ টা ৫৩ মিনিটে ঢাকার এক হাসপাতালে অনেকটা আকস্মিকভাবে। মৃত্যুর দুই ঘন্টা আগেও সচল ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে আরও অভিভাবকশূন্য করে দিল।
১ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎ করে প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের আরেকজন পুরোধা মাহবুব আলম। এবং ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনের যশশ্বী শিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতউল্লাহ। তিনজনের স্মৃতিতে পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
তথ্যঋণ: অনুপম হায়াৎ