চট্টগ্রাম ওয়াসার বোয়ালখালী ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর এলাকায় সুপেয় পানি নিতে চায় জাইকা। জাইকার অর্থায়নে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। এছাড়াও চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ক্যাচমেন্ট–১ (কালুরঘাট) ও ক্যাচমেন্ট–৪ (বাকলিয়া) প্রকল্পে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করছে জাইকা। জাইকার এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করার পর ডিপিপি তৈরী করে প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গড়ে উঠেছে ১২শ মেগাওয়াটের ২টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখান থেকে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুও হয়েছে। পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে গভীর সমুদ্র বন্দরের কর্মকাণ্ড।
বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ২০২৬ সালে চালু করা গেলে এই সমুদ্রবন্দর হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক হাব। ভিড়বে মাদার ভ্যাসেল। বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের হাতছানি নিয়ে বদলে দেবে গোটা দেশের অর্থনীতি।
ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পের পানি যাবে মাতারবাড়ি : মাতারবাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক হাবে এখন দেশি–বিদেশি প্রকৌশলী–শ্রমিকসহ প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক বসবাসকারী থাকলেও তাদের সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। জাইকা অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে আশেপাশে কোথাও তাদের লোকজনের পানির সংস্থান করতে না পেরে চট্টগ্রাম ওয়াসার শরণাপন্ন হয়েছে। প্রথমে চট্টগ্রাম ওয়াসা রাজি না হলেও পরবর্তীতে তাদেরকে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজি করানো হয়।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী একে এম ফজলুল্লাহ আজাদীকে বলেন, মাতারবাড়িতে পানি সরবরাহের জন্য জাইকার লোকজন প্রথমে আমাদের কাছে এসেছিল। আমরা প্রথমে রাজি হইনি। আমাদের এই জনবল নিয়ে নগরীতে পানি সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে তারা আবার এসে আমাদেরকে অনেকটা জোর করে রাজি করিয়েছে। তারা (জাইকা) বলেছে, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা ছাড়া আর কারো পক্ষে এটা (মাতারবাড়ি এলাকায় পানি সরবরাহ করা) সম্ভব না। এই সক্ষমতা একমাত্র ওয়াসার আছে। যেভাবেই হোক মাতারবাড়িতে পানি সরবরাহ দিতে হবে। প্রয়োজনে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবনা নিয়ে যাবো।’ এই প্রেক্ষিতে আমরা রাজি হয়েছি। শেষে তারা চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে মাতারবাড়ি পানি সরবরাহের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জাইকার আরো অন্যান্য প্রকল্পের সাথে এই প্রকল্পেও রাজি হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিকেলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে জাইকার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হারা শোহেই বৈঠক করেছেন। বৈঠকে জাইকার অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে প্রস্তাবিত দক্ষিণ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পানি সরবরাহ প্রকল্প, চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীন স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ক্যাচমেন্ট–২ ও ৪ বাস্তবায়নে অর্থায়ানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় এবং খুব দ্রুত প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে সাংবাদিকদের জানান স্থানীয় সমবায় মন্ত্রী।
স্যুয়ারেজ প্রকল্পে করবে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন : চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীতে ৬টি জোনে (ক্যাচমেন্ট–৬) স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এরমধ্যে হালিশহরে ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও স্যুয়ারেজের প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম আজাদীকে বলন, নগরীতে স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি ছয়টি জোনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগে। এই কাজের অগ্রগতি অনেক ভালো। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো নগরকে স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ শেষ হলে ২০ লাখ মানুষ এর সুবিধা পাবে। এর মধ্যে ১০ লাখ এসটিপি (সরাসরি পাইপলাইন) এবং ১০ লাখ ফিকেল স্ল্যাজ ম্যানেজমেন্টের (বর্জ্য সংগ্রহ) আওতায় আসবে। এর মধ্যে এসটিপি দৈনিক ১০ কোটি লিটার এবং এফএসটিপিতে ৩০০ টন পানি পরিশোধন করা সম্ভব হবে।
এছাড়া ক্যাচমেন্ট–২ (কালুরঘাট) ও ক্যাচমেন্ট–৪ (পূর্ব বাকলিয়া) অংশের কাজ শুরু হবে জাইকার অর্থায়নে। জাইকা এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করে ডিপিপি হওয়ার পর প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এখন একনেকে উঠবে এই প্রকল্পটি। স্যুয়ারেজের ক্যাচমেন্ট–২ (কালুরঘাট) ও ক্যাচমেন্ট–৪ (পূর্ব বাকলিয়া) এ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করবে জাইকা। এই দুটি ক্যাচমেন্টের আওতায় ৫ লাখ মানুষ স্যুয়ারেজের আওতায় আসবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে এই ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে জাইকার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হারা শোহেইয়ের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, প্রস্তাবিত চারটি প্রকল্পে জাইকার সহায়তার পরিমাণ ২০ হাজার ৫শ ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা হতে পারে। প্রকল্প চারটি হলো– প্রস্তাবিত দক্ষিণ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পানি সরবরাহ প্রকল্প, চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীন চট্টগ্রাম পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প ক্যাচমেন্ট–২ ও ৪ এবং হাওর বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবিকা উন্নয়ন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), উপজেলা প্রশাসন এবং উন্নয়ন প্রকল্প–২ (ইউজিডিপি–২)।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জাইকার সহায়তায় ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ১১ হাজার ৩শ ৪৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। চলমান অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের ২২৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। প্রকল্পগুলোতে সর্বমোট বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৮শত ৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
জাইকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হারা শোহেই বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাইকার যেসব প্রকল্প চলছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে, নতুন কিছু প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অনেক এগিয়েছে। আশা করছি এ ধারা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে চূড়ান্তভাবে বের হয়ে আসবে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আলী আকতার হোসেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁ, জাইকার সাউথ এশিয়া বিভাগের উপ–মহাপরিচালক সাকুডু শুনসুকে, জাইকা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তুমোহিদেসহ জাইকা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।