জলে স্থলে পাহাড়ে অবৈধ দখল ও উচ্ছেদ অভিযান

স. ম. জাফর উল্লাহ | রবিবার , ২৪ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

সরকারি জায়গা জমি ভূমি পাহাড় নদী ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে অবৈধভাবে বিভিন্ন সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা দখল করে সেখানে স্থায়ী অস্থায়ী বিভিন্ন অব কাঠামো তথা মার্কেট দোকান বাসা গুদাম বস্তি নির্মাণ করে ভোগ দখলের রাজত্ব কায়েম করছে। এসব দখলদারদের সাথে রয়েছে প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী। যতদিন স্বদলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকে ততদিন তাদের এসব অবৈধ দখলস্বত্বের উপর কোনও প্রশাসনের হস্তক্ষেপের ভয় থাকে না নির্বিঘ্নে চলে রামরাজত্ব। এক সময় নদী ভাঙনে ভূমিহীন ছিন্নমূল আবাসহীন অসহায় শ্রেণি আশ্রয়ের সন্ধানে এসব জায়গায় নিজেদের ঠাঁই করে নিত যা খুবই নগণ্য ও নিতান্ত মানবিক বিষয়। ক্রমে ভূমি দস্যু ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের বদ নজরে পড়ে এ সব সরকারি সম্পত্তির উপর তারা বনে যায় এক একটি এলাকার জমিদার। সরকারের স্থায়ীয়ত্বের উপর নির্ভর করে তাদের দখল বাণিজ্য। নদীর সীমারেখা বা সীমা পরিবর্তন করে গড়ে তোলা হয় স্থায়ী অস্থায়ী নানা স্থাপনা অপরিকল্পিতভাবে নদীর যে কোনো স্থান থেকে বালু উত্তোলনে। নদী ভাঙনে জনবসতি ভূমিধস ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সরকার বা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বন্ধে সরকারি দল বা বিভিন্ন সমিতির নামে সাঁটা হয় সাইনবোর্ড। এতে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ যেমন বাধাগ্রস্ত হয় নদী দূষণ ও ঘটে অতিমাত্রায়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা সৌন্দর্য বর্ধন নগরীর পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের আবাস গাছ গাছালী মনোরম দৃশ্য পাহাড় টিলা ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি অংশ। বাদ নেই সব স্থানে পাহাড় টিলা দখলের প্রতিযোগিতা যার যার ক্ষমতা প্রভাব অনুযায়ী প্রত্যেক পাহাড় অবৈধ দখলদারদের নিজস্ব ভূসম্পত্তিতে পরিণত হয়। এখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিন্নমূল শ্রেণির বাসা বস্তি নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভয়ারণ্যের নিরাপদ ক্ষেত্র। চর এলাকা সমতল ভূমি যা সরকারি খাস বা কোনো পরিত্যক্ত জায়গা এসব ভূমিও ক্রমে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একক বা সিন্ডিকেট দ্বারা বেদখলভুক্ত হয়ে যায়। নালা নর্দমা ফুটপাত কিছুই বাদ যায় না দখলদারিত্বের থাবা থেকে। ভূমি যেহেতু অবৈধ সেখানে গড়ে তোলা স্থাপনা সমূহে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ গ্যাস পানি সুবিধাগুলো কীভাবে প্রদান করা হয় এ প্রশ্নের জবাব কখনও মেলেনি। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও এসব নাগরিক সুবিধা পেতে যেখানে জনগণের গলদঘর্ম অবস্থা সেখানে অতি সহজে অবৈধ স্থাপনায় এসব সুবিধা প্রাপ্তি রহস্যজনক। সরকারি সম্পদ রক্ষায় প্রশাসনিক বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে। কোনও সম্পদ একদিন বা রাতারাতি দখল হয় না সময় নিয়ে ধীর স্থিরভাবে দখল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনের দোর গোড়ায় চোখের সামনে সরকারি সম্পদ বেহাত হতে থাকলেও প্রশাসনের নজরে পড়ে না। সরকারি সম্পত্তির তালিকা প্রশাসনের নখদর্পণে সে সব সম্পত্তি যথাযথভাবে সংরক্ষিত আছে কিনা নিয়মিত মনিটরিং করা সংশ্লিষ্ট দফতরের দায়িত্ব। দখলকৃত জায়গায় বাসা বস্তি দোকান বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনায় যারা বসবাস বা ছোটখাটো দোকান পাতি ভাড়া নিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে তারা সমাজের নিম্ন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। এসব স্থাপনায় যারা বসবাস ও ব্যবসাপাতি করে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে একটি স্বপ্ন বুনে বিভিন্ন অর্থ লগ্নকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ধারদেনা করে সন্তানদের পড়ালেখা ভবিষ্যত স্বাবলম্বী হওয়া মাথা গোঁজার দীর্ঘ মেয়াদী একটি পরিকল্পনা আঁটে। এক স্থানে অনেক দিন যাবৎ বসবাসের কারণে তাদের জীবন যাত্রার শেকড় গভীর ও বিস্তৃত লাভ করে। সরকার আসে সরকার যায় তাদের গায়ে কোনো আঁছড় পড়ে না। পত্র পত্রিকায় কোন সংবাদ দখল নিয়ে কোনও সংঘাত সংঘর্ষ বা পাহাড় ধসে কোনও প্রাণহানি ঘটলে তখন প্রশাসনের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। ঘন ঘন দুচারটি মিটিং, দখলদার ও বসবাসকারীদের তালিকা প্রণয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ সর্তকতামূলক প্রচার প্রচারণা উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত।

বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক উত্তেজনা, দখলদারদের তদবির তৎপরতা, এভাবে সময়ক্ষেপণ অবশেষে নানা অভাব অভিযোগ সমন্বয়হীনতা জনবলের সংকট ইত্যাদি অজুহাতে উচ্ছেদ অভিযান চলে যায় হিমঘরে। আগে কখনো বন্যপ্রাণী হাতি বানর অজগর লোকালয়ে এসে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করতে দেখা যায়নি। বন জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর আবাস খাদ্য ও নিরাপত্তার পরিবেশ অবৈধ বন খেকোদের দ্বারা বিপর্যস্ত। ফলে বন্যপ্রাণী জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি অন্যতম কারণ। শুধু সরকারি সম্পদ নয় নগরীর নালা নর্দমা, ফুটপাত, খাল, অবৈধ দখল থেকে বাদ নেই। মেয়র প্রশাসক আসে যায় ক্ষমতার প্রথমার্ধে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে নানা উদ্দ্যোগ আয়োজন পদক্ষেপ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছু বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হবার পর দৃশ্যপট পূর্বের স্ব অবস্থানে ফিরে আসে। প্রথম থেকেই যদি কঠোর নজরদারির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে উচ্ছেদ অভিযানের নামে প্রশাসনকে প্রতি বছর একই ঘটনার অবতারণা করতে হত না।

রাষ্ট্রীয় হোক ব্যক্তি বিশেষের হোক কোনও সম্পদই অরক্ষিত থাকলে তা বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর জবরদখল সংস্কৃতিটা সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে। প্রশাসন ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ পর্যন্ত যেতে না পেরে মুখ রক্ষার উচ্ছেদ অভিযানে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাও রাজনৈতিক প্রভাব। অবৈধ দখল সংস্কৃতি তখনই বন্ধ হবে রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র যখন সংশোধন হবে। না হয় এভাবে চলতে থাকবে দখল আর উচ্ছেদ প্রক্রিয়া যার মাশুল গুণতে হবে দেশ ও জাতিকে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধআজ শিল্পকলায় অমবস্যা ও কাঁদে বাংলা কাঁদে মাটি