আগামী বর্ষায় নগরে জলাবদ্ধতা সহনীয় রাখতে ৮ দফা করণীয় ঠিক করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিশেষজ্ঞ কমিটি। শহরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জলাদ্ধতাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে নির্ধারিত এসব করণীয়’র মধ্যে আছে ১০টি খাল খনন ও ৯টি খালের মুখ পরিষ্কার, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের বক্স কালভার্ট পরিষ্কার, চারটি খালসংলগ্ন স্থানে সিল্ট ট্র্যাপ (বালি আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণ, বারইপাড়া ডাইভারশন চ্যানেলে সংস্কার, খালে ভাসমান প্লাস্টিকসহ পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী ভাসমান পণ্য আটকে তুলে ফেলা ও স্লুইচ গেট সংস্কার।
গতকাল বুধবার টাইগারপাস চসিকের সম্মেলন কক্ষে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসন বিষয়ক সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে করণীয়গুলো তুলে ধরে চসিক, সিডিএ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে আগামী ৩০ মে–এর মধ্যে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন চসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ায় ড্রেনেজ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ড. আবদুল্লাহ আল মামুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার মোহাম্মদ শামসিত তাবরীজ, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ও চসিক মেয়রের জলাবদ্ধতা বিষয়ক উপদেষ্টা শাহরিয়ার খালেদ। সভায় অংশগ্রহণকারীরা একমত হন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি তদারকি করতে হবে। মেয়র এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করার কথা বলেন।
এ সময় সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা কেবল সিটি কর্পোরেশনের একক প্রচেষ্টায় সমাধান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্নভাবে কাজ করছি। অভিজ্ঞদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য চট্টগ্রামের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও জলধারণ সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা চাই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হোক এবং তা কার্যকর হোক। এজন্য পরিকল্পিত ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
মেয়র বলেন, শহরকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে না পারলে শহরকে ক্লিন–গ্রীন কীভাবে করবো? সিডিএ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও জলাবদ্ধতা হলে মানুষ কর্পোরেশনেকে দায়ি করে। তাছাড়া মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধায় কষ্ট পাচ্ছে, তাই এটা নিয়ে কাজ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, শুধু খাল পরিষ্কার করলে হবে না, মানুষ সচেতন না হলে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না। তখন জলাবদ্ধতার টাকা জলেই যাবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর চলমান প্রকল্পে বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে জানিয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে খাল খনন ও পরিষ্কারের কাজ শুরু করা হয়েছে। সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গেও সুপারিশগুলো নিয়ে বসেছি। তারাও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। সিডিএর প্রকল্পে ৫৭ খালের মধ্যে ২১টি বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। না হলে জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর হবে না।
৮ দফা করণীয়গুলো : প্রতিবেদনে যে ১০টি খাল থেকে ময়লা–আবর্জনা দ্রুততার সাথে অপসারণের জন্য বলা হয়েছে সেগুলো হল– চাক্তাই খাল, মহেশখাল, ডাইভারশন খাল, বদরখালি খাল, জামালখান–সাবএরিয়া কাজীর খাল, রুমঘাটা জেলেপাড়া ছড়া, দেবপাহাড় ছড়া, চট্টেশ্বরী খাল, হিজড়া খাল এবং বাদুরতলা ছড়া। ময়লা–আবর্জনা অপসারণের মাধ্যমে এসব খালের আয়তন আরও তিন থেকে চার মিটার প্রশস্ত করার কথা বলা হয়েছে, যাতে পানিপ্রবাহ আরও সহজ হয়।
এছাড়া যে নয়টি খালের প্রবেশমুখ পরিষ্কারের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো– চাক্তাই খাল, কাট্টলী খাল, রাজাখালী খাল, ডাইভারশন খাল, উত্তর কাট্টলী নাজির খাল, আকমল আলী খাল, সদরঘাট খাল (মনোহর খাল), ডোমখালী খাল এবং নোয়াখাল। এ কাজ বন্দরকে করতে বলা হয়।
পলি আটকাতে জামালখান–সাবএরিয়া খাল, রামপুর খালের প্রবেশমুখ, গয়নার ছড়ার প্রবেশমুখ এবং ডিসি রোড বাদামতলী পয়েন্টে ‘সিল্ট ট্র্যাপ’ তৈরির প্রস্তাব করা হয়।
উত্তর কাট্টলীর নাজিরখালে নির্মিত একটি স্লুইচগেট থেকে স্লাইডিং প্লেট চুরি হয়ে যাওয়ায় অবাধে সাগরের পানি ঢুকে পড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে সেটি সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি রাণী রাসমনি ঘাটে থাকা আরেকটি স্লুইচ গেটও সংস্কারের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া বারইপাড়া ডাইভারশন চ্যানেলে সংস্কার, আগ্রাবাদ বঙ কালভার্ট পরিষ্কার করা, খালে ভাসমান প্লাস্টিকসহ পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী ভাসমান পণ্য আটকে তুলে ফেলতে বলা হয়।
ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মেয়রের অনুরোধে অস্ট্রেলিয়ার কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে মার্চে চট্টগ্রামে এসেছি। এই সময়ে নগরের খাল, নালা, নর্দমাগুলো ঘুরে দেখেছি এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এর ভিত্তিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প মেয়াদে করণীয় নির্ধারণ করেছি। তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে টেকসই পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
শাহরিয়ার খালেদ বলেন, খাল ও নালা পরিষ্কার করতে হবে। খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, নইলে যে কোনো প্রকল্পই ব্যর্থ হতে পারে।