জলাবদ্ধতা নয় : এবার আশার আলো

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন | বুধবার , ১৬ জুলাই, ২০২৫ at ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রায় হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন। শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বছরের পর বছর সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো হাঁটু থেকে গলা পানিতে তলিয়ে যেত। মার্চএপ্রিল থেকেই যেখানে বৃষ্টির আনাগোনা শুরু হয়, জুনে এসে তা পরিণত হতো দুঃস্বপ্নে। এবছরও যখন বর্ষার মেঘ ঘনিয়ে আসছিল, আতঙ্ক ছিল চোখেমুখে। কিন্তু, এবার একটি ব্যতিক্রম ঘটেছে, আর সেটাই সবাইকে চমকে দিয়েছে।

বছরের শুরুতে, ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে আমি সিডনির নিজ বাড়িতে বসে। হঠাৎ মোবাইলে ফোন, অপর প্রান্তে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় ডা. শাহাদাত হোসেন। মেয়র মহোদয় জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান কাজগুলোর অসঙ্গতি খতিয়ে দেখে সিটি কর্পোরেশানকে কিছু বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা দিতে অনুরোধ করলেন। একই সঙ্গে জানালেন, খ্যাতিমান পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা শাহরিয়ার খালেদকে জলাবদ্ধতা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

আশির দশকে চাক্তাই খাল রক্ষায় আন্দোলন করেছিলেন যেই শাহরিয়ার, তিনিই আজও খাল রক্ষার লড়াইয়ে অবিচল। চট্টগ্রামের খালনালার এমন কোনো দিক নেই, যার খুঁটিনাটি তাঁর অজানা। তাঁর মতো মাঠভিত্তিক অভিজ্ঞতা আর বাস্তব জ্ঞান চট্টগ্রামে বিরল।

প্রবাস জীবনে চার দশকের অভিজ্ঞতায় আমি বহু দেশের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। তাই প্রাণের শহর চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা আমাকে সবসময়ই নাড়া দিত। প্রবাসে থাকলেও এই শহরের দুর্দশা চোখে ভাসত। যতবার দেশে গিয়েছি, ততবারই শাহরিয়ার খালেদের সঙ্গে শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে খালনালার বাস্তব পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখেছি, বিশ্লেষণ করেছি। ভেবেছি, এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার টেকসই সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে। মনে হত আমার এই অভিজ্ঞতা যদি দেশের কাজে লাগাতে পারতাম!

মেয়র সাহেবের আন্তরিক আমন্ত্রণ আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করল। মনে হল, প্রাণের শহর চট্টগ্রামের জন্য যদি সত্যিই কিছু করতে চাই, তাহলে সময় এখনই। তাই অফিসের প্রচণ্ড কাজের চাপ উপেক্ষা করেই আর দেরি না করে তিন দিনের মাথায় চট্টগ্রামে চলে এলাম। সহৃদয় মেয়র সাহেব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গেস্ট হাউসে আমাকে থাকার সুব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি, যাতায়াতের সুবিধার্থে আমাদের দু’জনের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিলেন।

শুরু করলাম সরেজমিন পর্যবেক্ষণ। শাহরিয়ার ও আমি শহরের প্রতিটি সমস্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখলাম। মাঠ পর্যায়ে না নামলে সমস্যার আসল চিত্র ধরা পড়ে না, এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। যেখানে অন্যরা মাসের পর মাস লাগাতেন, আমরা অভিজ্ঞতা আর প্রস্তুতির জোরে সাত দিনের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবভিত্তিক চিত্র দাঁড় করিয়ে ফেললাম।

মাঠে গিয়ে বাস্তব চিত্র দেখে বিস্মিত হলাম, খাল, নালা ও ড্রেন দখল করে উঠেছে বাড়ি, দোকান, বিশাল মার্কেট, এমনকি মসজিদও। আর এই অবৈধ দখলের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালীদের হাত, যাঁদের হাতেই আবার শহর রক্ষার দায়িত্ব!

লক্ষ্য করলাম, অনেক ভালো কাজ হচ্ছে, কিন্তু তা বিচ্ছিন্নভাবে। নেই সমন্বয়। অথচ জলাবদ্ধতা এমন একটি সমস্যা, যা এককভাবে নয়, সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করতে হয়।

তবে আশার বিষয়ও কম ছিল না। সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড প্রায় তিন ডজন খালের উন্নয়ন কাজ করছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় খালের দু’পাশের অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও যুগান্তকারী।

উপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখে তিন সপ্তাহের মধ্যে শহরের জলাবদ্ধতা প্রবণ হটস্পট এলাকাগুলোর জন্য একটি ৮ দফা স্বল্পমেয়াদী অ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করে মেয়র মহোদয়ের হাতে তুলে দেই। সরকার কর্তৃক জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন উপদেষ্টাও এই অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন।

সবার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে মেয়রের কার্যালয়ে আয়োজিত একটি আন্তঃসংস্থা সভায় অ্যাকশান প্লানটি আমরা তুলে ধরি। এই সভায় সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার করণীয় নির্ধারণ করে দিয়ে কাজ সম্পন্ন করার জন্য মে মাস পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। যেমন খালের মুখ খননের দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষকে, খাল খননের দায়িত্ব সেনাবাহিনী ও সিটি কর্পোরেশনকে, স্লুইচ গেট ও পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ইত্যাদি। মেয়রের উদাত্ত আহ্বানে সবাই সম্মত হন একযোগে কাজ করতে।

কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একাধিক বড় বড় মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও, সেগুলোর অনেকটাই কাগজেকলমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঠপর্যায়ে এসব পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যাটা কোথায়, সেটাই সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে সমস্যার মূল উৎস চিহ্নিত না হওয়ায় সমাধানও কার্যকরভাবে হচ্ছে না।

কেবল পরিকল্পনা তৈরি করলেই হবে না; পরিকল্পনার সঠিক ও সময়মতো বাস্তবায়ন না হলে সেটি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই সিডনিতে ফিরে যাওয়ার পরও আমি বিষয়টি অবহেলা করিনি। নিয়মিত সেই আট দফা অ্যাকশন প্ল্যানের অগ্রগতি মনিটর করে চলেছি। প্রতিদিন একাধিকবার শাহরিয়ার খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজের অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করি। কোনো সমস্যা দেখা দিলে, আমরা দু’জন মিলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের উপযোগী পথ খুঁজে বের করি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদি সময়মতো এই কর্মপদ্ধতিগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা অন্তত সাময়িকভাবে হলেও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

এই উদ্যোগের ফলাফল মিলতে সময় লাগেনি। মার্চের শেষ সপ্তাহে দুই দিনের প্রবল বর্ষণে দেখা গেল, আগে যেসব এলাকা হাঁটু বা কোমর পানিতে ডুবে যেত, সেসব এলাকা প্রায় শুকনো! চকবাজার, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, প্রবর্তক মোড়, হালিশহর, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, রামপুর, মুহুরী বেপারী পাড়া ও ঘাসিয়ার পাড়া হালিশহর, সব জায়গাতেই দৃশ্যমান পরিবর্তন। গণমাধ্যমে শিরোনাম আসে: ‘অতি ভারী’ বৃষ্টিতেও ডোবেনি চট্টগ্রাম নগরী।

জিইসি ও ওয়াসার মোড়, কাতালগঞ্জ এলাকায় সাময়িকভাবে পানি উঠলেও তা দ্রুত নেমে গেছে। ওই এলাকায় বর্তমানে কাজ চলমান রয়েছে এবং আশাবাদী যে খুব শীঘ্রই সমস্যার সুরাহা সম্ভব হবে।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের এই সাফল্য কোনো একক ব্যক্তির নয়। এটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ফল, যেখানে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং সঠিক মেধার ব্যবহার, প্রশাসনের সমন্বয় ও মাটির কাছাকাছি কাজই তৈরি করেছে এক নতুন সম্ভাবনার চিত্র।

চট্টগ্রামবাসী এবার বুঝতে পেরেছেন পরিবর্তন সম্ভব, যদি নেতৃত্বে থাকে দূরদর্শিতা, আর মাটিতে থাকে সত্যিকারের কাজ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খুব তাড়াতাড়িই হয়তো চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা জাদুঘরে জায়গা করে নেবে।

লেখক: সিডনী প্রবাসী ড্রেইনেজ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ