১৬৯ বছর পূর্বে ১৮৫৬ সালের আজকের দিনে (১৪ মে) অনুষ্ঠিত হয় ‘কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাং’ নামে কমিটির প্রথম সভা। চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়নে গঠিত ওই কমিটির প্রথম সভায় শহরের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৬২ সালের ২৪ এপ্রিল কমিটির ১০০টি সভা হয়। এর মধ্যে প্রথম সভার কার্যবিরণীতে বলা হয়, ‘শহরের লোকজন যেখানে বসবাস করে সেখানে এ সমস্য ছিল গুরুতর।’ সমস্যাগুলোর সমাধানে সভায় শহরের খাল–নালার উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এজন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি উপ–কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাংয়ের সভাগুলোর কার্যবিবরণী সূত্রে বলা যায়, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যা ১৬৯ বছরের পুরনো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এত পুরনো একটি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন? এ সমস্যা সমাধানে কী কোনো উদ্যোগ ছিল না?
জানা গেছে, কমিটি ফর দি স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অব দি টাউন অব চিটাগাংয়ে গৃহীত পদক্ষেপের ১৩৯ বছর পর ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম শহরের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার বিষয়টি আবার জোরালো আলোচনায় আসে। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচএসের সহায়তায় প্রণীত হয় ২০ বছর মেয়াদি ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান; যা ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। মাস্টার প্ল্যানে জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু সুপারিশ ছিল। গত ৩০ বছরে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে অল্প বৃষ্টিতে এখনো জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছেন নগরবাসী।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগ : জলাবদ্ধতা নিয়ে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার মাঝে আশার আলো হয়ে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রামের সন্তান তিনি। অবগত আছেন চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতার বিষয়ে। তাই অগ্রাধিকার দিয়ে জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে তদারকি করতে দায়িত্ব দেন চারজন উপদেষ্টাকে। তাদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
চার উপদেষ্টা হচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষযক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
৫ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে প্রথম সভা করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। এরপর ১৮ জানুয়ারি জলাবদ্ধতা প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা জানতে নগরের বিভিন্ন খাল ও ড্রেন সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরদিন ১৯ জানুয়ারি সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, বন্দর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোর সাথে বৈঠক করেন। এতে এ বছর জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে ১১টি করণীয় নির্ধারণ করে তার বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), সিডিএ, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেন পরিষ্কারসহ ১১টি করণীয় নির্ধারণ করে তা শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। নির্ধারিত করণীয়গুলো চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বাস্তবায়ন করতে হবে। বলা হয়, যে সংস্থা বাস্তবায়ন করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত প্রথম সভার পর থেকে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে থাকে। গতি পায় খাল খননসহ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ। এর বাইরে সিটি কর্পোরেশন নগরের বিভিন্ন খাল–নালা পরিষ্কার শুরু করে। এগিয়ে আসে বিএনপি–জামায়াতও; দল দুটির উদ্যোগেও পৃথক খাল খনন শুরু হয়। তৎপর হয় বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসনও। ফলে সামগ্রিক প্রস্তুতি দেখে নগরবাসী বলাবলি করছেন, ‘এবার ভালো কিছু হবে’।
১৯ জানুয়ারি প্রথম সভা করে শেষ করেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একেকজন উপদেষ্টা চট্টগ্রাম এসে পর্যবেক্ষণ করেন কাজের অগ্রগতি। সর্বশেষ গতকাল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আগ্রাবাদ বঙ কালভার্ট, মহেশখাল, নাজির খাল ও বির্জা খালের পরিচ্ছন্নতা কাজ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমি আগে যখন এসেছিলাম, দেখেছিলাম খালের উপর বাড়ি ছিল। এমনকি সিডিএরও বাড়ি ছিল। এগুলো সব ভেঙে খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। মার্কেট ছিল, নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর এসব ভেঙে এখন আবারও খালে পরিণত করার কাজ করছি। আমরা সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করেছি। এ এক বিশাল সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা সবাইকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চাই।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস আজাদীকে বলেন, এবার ভালো কিছু হবে। সমন্বিতভাবে সবাই কাজ করছেন। লজিক্যালি এবার জলাবদ্ধতা সহনীয় থাকার কথা। ২৫টি খালের কাজ শেষ করেছি। খালে যদি পানি আসতে পারে চলে যাবে। প্রকল্পে ৩৬টি খাল থাকলেও এর বাইরে ২৫ কিলোমিটার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পরিষ্কার করেছি। এটা চলমান আছে। এটাকে ৩০ কিলোমিটারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। আসলে প্রত্যেকটা প্যারামিটারে বেটার অবস্থানে আছি। তাই আশা করছি এবার ভালো কিছু হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্প : জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে বর্তমানে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ শতাংশ। প্রকল্পভুক্ত ৩৬ খালের মধ্যে ২৫টির কাজ শেষ হয়েছে।
সিডিএর ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। প্রকল্পটির পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ আজাদীকে বলেন, ১২টি রেগুলেটরের মধ্যে ১০টির কাজ শেষ হয়েছে। সেগুলো চালু আছে। বাকি দুটির কাজ চলমান। নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হবে।
চসিকের গৃহীত ‘বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ শতাংশ। প্রকল্পটির পরিচালক ও চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম আজাদীকে বলেন, প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। এছাড়া চলমান আছে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় গৃহীত ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প।