সড়ক এবং অলিগলি ডুবে আছে পানিতে। নিচু এলাকার বাসা–বাড়ির নিচতলা, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা মানেই এ দৃশ্য চোখ বন্ধ করে বলা যায়। তবে জলাবদ্ধতা মানেই কেবল পানি আর পানি নয়। এর সঙ্গে আছে পানিবন্দী মানুষ ও পথচারীর দুর্ভোগ এবং ভোগান্তি। আছে আর্থিক ক্ষতিও।
চলতি মৌসুমে গত তিন দিন টানা জলাবদ্ধতায় সীমাহীন দুর্ভোগে আছেন নগরবাসী। শহরের নিচু এলাকায় দোকানপাটে পানি ঢুকে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে মধ্যে প্রথম দিন চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের কয়েকটি চালের গুদামে পানি ঢুকে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। এবার অবশ্য বিগত সময়ের তুলনায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে। তবে রেয়াজুদ্দিন বাজারের ৩শর বেশি দোকানে পানি ঢুকে ক্ষতি হয় প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়া চকবাজার চক সুপার মার্কেটসহ অন্যান্য এলাকার দোকানপাটেও পানি ঢুকে আরো কয়েক কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে গত তিন দিনে। এর সঙ্গে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ তো আছেই।
জলাবদ্ধতায় ৮০ শতাংশ মানুষের দুর্ভোগ : ১৬৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার দুভোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন নগরবাসী। দীর্ঘ এ সময়ে বা জলাবদ্ধতায় প্রতিবছর নগরে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তার পূর্ণাঙ্গ এবং সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কাছে। এ নিয়ে কোনো গবেষণাও হয়নি সাম্প্রতিক সময়ে। তবে জুন মাসে প্রকাশিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরশেনের ‘মাল্টি হ্যার্জাড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর চলমান মেগা প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নিবিড় পরীবিক্ষণ প্রতিবেদন এবং ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য রয়েছে।
এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতার কারণে ৮০ দশমিক ২৭ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগের শিকার হন। এছাড়া ৫৪ দশমিক ৩২ শতাংশের প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে, ৩১ দশমিক ৮৯ শতাংশের সময়ের অপচয় হয়। একইসঙ্গে ২০ দশমিক ৮১ শতাংশের ব্যবসায়, ১৮ দশমিক ১১ শতাংশের আর্থিক এবং ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশের সম্পদের ক্ষতি হয়। লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশের। এমনকি দুই দশমিক ৯৭ শতাংশ অসুস্থ হয়েছেন বা শারীরিকভাবে আঘাত পেয়েছেন জলাবদ্ধতার কারণে। জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের শিকার হন ২৭ দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষ এবং ৩ দশমিক ৭৮ মানুষ হয়রানির শিকার হন।
গত জুন মাসে প্রকাশিত চসিকের আপদকালীন পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, জলাবদ্ধতার ফলে শহরের দশ শ্রেণি–পেশার মানুষকে গুরুতরভাবে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৯ শতাংশ। জলাবদ্ধতার ফলে ১৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়। এতে ব্যাহত হয় শিক্ষা কার্যক্রম। হাসপাতাল প্লাবিত হওয়ায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত সবাইকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় জলাবদ্ধতার কারণে। এছাড়া জলাবদ্ধতার ফলে শহরের আবাসিক কাঠামোর এক ষষ্ঠাংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরের ৪৭ শতাংশ রাস্তা ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ হাজার গুদামসহ খাতুনগঞ্জের প্রধান সড়কের উভয় পাশে ২২৪টি স্থাপনা জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এর আগে চসিকের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরের মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় জলযট হয়। এতে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাক্তাই–খাতুনগঞ্জসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্ষতি কেমন : গত বছরের (২০২২) অক্টোবর মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে চাক্তাই ও রাজাখালী খালে। এই দুই খালের অতিরিক্ত পানি পাইকারি মোকাম চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছাদগঞ্জে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এতে ক্ষতি হয়েছে শতকোটি টাকার। অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে টানা বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে বিগত সময়ের তুলনায় সেখানে তেমন ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে প্রতি বছর দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানিগঞ্জে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে অতিবৃষ্টিতে হয় জলাবদ্ধতা। দীর্ঘ এ সময়ে জলাবদ্ধতায় পরিত্যক্ত হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর গুদাম। তাই ক্ষতি এড়াতে চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসার ৫০ শতাংশ অন্যত্র চলে গেছে। চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের পাশেই চাক্তাই খাল। দিনে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে চাক্তাই খালসহ আশপাশের খালে পানির উচ্চতা ৪ দশমিক ১ মিটার বেড়ে যায়। এতে প্রধান সড়কে ১ মিটারের উঁচু পানি জমে যায়। জোয়ার হলে তা আরো বৃদ্ধি পায়। চট্টগ্রাম চেম্বারের সহযোগিতায় ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এর যৌথ এ গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের আর্থিক ক্ষতির তথ্যও তুলে ধরা হয়। এই এক দশকে জলাবদ্ধতায় চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে দুই হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৭৫ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ১৮২ কোটি টাকা, ২০১৩ সালে ১৮৩ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ১৮৯ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ২০৮ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ১৯৭ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৪০২ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ২২৯ কোটে টাকা এবং ২০২০ সালে ক্ষতি হয় ৫১৪ কোটি টাকা। পণ্যের ক্ষতির পরিমাণ, অবকাঠামো ও সম্পদের ক্ষতি, অবকাঠামো খাতে বাড়তি বিনিয়োগ, পরিবহনসেবা ও শ্রম খাতে কর্মঘণ্টা নষ্ট এবং বাড়তি পরিচালন ব্যয় মিলিয়ে এ ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সরাসরি এই ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
গত তিন দিনের জলাবদ্ধতায় ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী আজাদীকে বলেন, তেমন ক্ষতি হয়নি। দোকানপাটে পানি ঢুকেনি। গোডাউনে আগে থেকে বেষ্টনি দিয়ে রাখায় রক্ষা পেয়েছে। তবে স্লুইচ গেইট ও বেড়িবাঁধের সুফল পুরোপুরি পাচ্ছি না।
চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলাইমান বাদশা আজাদীকে বলেন, প্রথমদিন সামান্য পানি উঠে। এরপর তেমন পানি উঠেনি। ব্যবসায়ীরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হননি।
জানা গেছে, ২ আগস্ট চাক্তাইয়ের কিছু কিছু গুদামে পানিও ঢুকে যায়। ওইদিন চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম সাংবাদিকদের বলেন, জোয়ারের পানিতে চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ এলাকায় পানি উঠে গিয়েছিল। কিছু কিছু গুদামেও পানি ঢুকে।
এদিকে চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও রেয়াজুদ্দিন বাজারে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রেয়াজুদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির কার্যকরী সদস্য এস এম মিজানুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, তিন দিনে তিনশর বেশি দোকানে পানি ঢুকেছে। আজ (গতকাল) ইসলাম মার্কেট, নালা মার্কেট, শাহ আমানত টাওয়ার ও এজাহার ম্যানশনে বেশি পানি ঢুকে। জুতা, কাপপড়, রেডিমেড গার্মেন্টস, মোবাইল এঙসরিজের দোকানে পানি ঢুকে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।