জলকুমারী

সুসেন কান্তি দাশ | বুধবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

সন্ধ্যা হতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। একটানা জলের স্রোতে নীচু এলাকা ইতিমধ্যে ডুবে গেছে। দূর হতে কারোকারো ডাক শোনা যায়। মূলত এই ডাক প্রিয়জনকে সতর্ক করা।

শান্তিপুর গাঁয়ের লোকেরা অধিক বৃষ্টিপড়ায় আনন্দের চাইতে আতঙ্কিত বেশি থাকে। গাঁয়ের কাছেই বয়ে গেছে মায়াবতী নদী। এই নদী এমনিতে অনেক শান্ত থাকে। সারাবেলা ছলাৎছলাৎ ঢেউ তুলে দূরে বয়ে যায়। তখন নদীর মাঝি গলা ছেড়ে গান গেয়ে স্রোতে ভেসে যায়। তীরে বসে ঘটিবাটি পরিষ্কার করে মায়েরা ও দিদিরা। কেউবা সাঁতার কেটে জলে ভেসে যায় হাঁসের মতোন। কিন্তু বর্ষাকালে তার রূপ হয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনি করে একটানা বৃষ্টিতে ছলছলকলকল শব্দে গতিবেগ বাড়িয়ে আছড়ে পড়ে পাড়ের দু’কূলে। এতে করে পাড় ভাঙতেভাঙতে গাঁয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছে। নদী তীরে কোনো কোনো কুঁড়েঘর যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। তবুও ওখানে মানুষ থাকে। নদীর সাথে মিতালী করে।

নদীর এপাড়ওপাড় নৌকা বেয়ে লোক পারাপার করে। গ্রামবাসীদের প্রিয়জন “আনু মঝি”। অতি সাদাসিধে জীবন তার। নদীতীরে একলা ঘরে একা থাকেন তিনি। সারাবেলা নৌকা ভাসিয়ে যা আয় করে তাতেই বেশ চলে। লোকটি বেশ উপকারী। কারো জ্বর হলে, কিংবা বিশেষ কিছুর প্রয়োজনে ডাক্তার ডেকে দেয়া, ওপারে পৌঁছে দেয়া তার কাজ।

রাত বেড়ে চলেছে। বৃষ্টি থামার নাম নেই। নদীতে বৃষ্টিজল মিশে কানায়কানায় পূর্ণ হয়ে শোঁশোঁ শব্দ তুলছে। কোথাও পাড় উপচে এলাকায় ঢুকে গেছে ঢলের জল। সন্ধ্যে বেলায় আনু মাঝি তরী বেঁধে এসেছে। মাথায় পলিথিন মুুড়িয়ে জুঁইর ধরে টর্সের আলো জ্বালিয়ে নৌকাটি ঠিকভাবে আছে কিনা দেখে আসে। কোনোভাবে বাঁধ ছিঁড়ে চলে গেলে ফিরে পাওয়া যায়।

একটুএকটু করে বৃষ্টি কমে আসে। তবু মেঘেমেঘে ঘর্ষণ লেগে বিদ্যুৎ চমকায়। কখনো গুড়ুমগুড়ুম শব্দে নতুন করে বৃষ্টির আশঙ্কা জাগায়।

আনু মাঝি তীরে এসে নৌকা দেখতে এসে কোনো এক শিশুর কান্না শুনে কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। আশপাশে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দ শোনা যায়, আরো ভালোভাবে কান পেতে খেয়াল করলোনদীর স্রোতে ভেসে এ শব্দ মিশে যায়। টর্স উঁচিয়ে ধরে মাঝি দেখতে পায়। নদীজল ঘোলা হয়ে বেগতিকভাবে ছুটছে। এ যেনো দুরন্ত গতিতে উড়ন্ত পাখির চেয়েও অধিক গতির।

এসময় চোখে পড়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে একটি বড় পাত্র। সেদিক থেকেই বাচ্চা শিশুর কান্না ভেসে আসছে। অজানা আশঙ্কায় শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে আনু মাঝির। তবু একপা দু’পা করে স্রোতের সাথে পা চালিয়ে যায়। কখনো স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে মাঝি ছুটতে থাকে। টর্সের আলোয় নিশানা ঠিকমতো লক্ষ্য করা যায় না।

এভাবে যেতে যেতে পাড়ভাঙা এক গাঁয়ের পাশে এসে থামে। আনু মাঝি এখানেই কোথাও কান্নাস্বর থমকে আছে। টর্সের আলোয় দেখা যায়, একটি জলের সাথে হেলে থাকা নারিকেল গাছের সাথে আটকে আছে একটি হাঁড়ি। মাঝি নিশ্চিত হয়ে গেলোওখানেই কোনো শিশু কাঁদছে। ধীরে পাড় বেয়ে নেমে মাঝি স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে। কোনোমতে হাঁড়ির কাছাকাছি এসে থামে। দেখে বেশ বড় আকারের হাঁড়ি এটি। ভেতরে জল ঢুকে আছে অনেকটা। তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে কান্নারত শিশুটি। টর্সের আলোতে তার মুখখানা দেখতে গিয়ে হাত থেকে টর্সটা নদীতে পড়ে গেলো। মনের খেয়ালে হাঁড়িটার দুপাশে শক্ত করে ধরে স্রোত ঠেলে কুলে উঠে এলো। মাঝি অনুমান করে বুঝতে পারলোকেউ বুঝি নদীতে ডুবে পড়ার মুহূর্তে এ শিশুকে হাঁড়িতে ঢুকিয়ে রেখেছে।

কৌশলে হাঁড়িটা মাথায় তুলে আনু মাঝি তার ঘরে ফিরে। এসময় ঝমঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হলো। হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে ভেতর থেকে বের করে আনলো শিশুটিকে। অনেকক্ষণ জলের সাথে থাকা। নীলবর্ণ হয়ে গেছে। অদিক স্নেহে শিশুর শরীর মুছে দেয়। মাথা মুছিয়ে দেয়। অতঃপর তেল গরম করে তার সারা শরীরে মাখিয়ে দেয়। এভাবে প্রায় সারারাত সেবা করে বাচ্চাটিকে অনেকটা সুস্থ করে তুলে।

পরদিন ভোরবেলা। বৃষ্টি কমে আসে। আনু মাঝির ঘরের বাইরে উঠোনে জল জমে পুকুরের মতো দেখাচ্ছে। বাড়ির কাছেই থাকেন কবিরাজ। তাকে ডেকে এনে শিশুটির চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেন।

ক্রমে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েকদিন কেটে গেলো। এর মধ্যে নানান জায়গা ঘুরে বাচ্চাটির নিকটজনকে খুঁজে পায়নি মাঝি। বরং তার কোলে হেসে খেলে বাচ্চাটি কেবল মায়া বাড়াতে থাকে। এভাবেই একদিন বাচ্চাটি মাঝির স্নেহে বাঁধা পড়ে গেলো।

একদিন শিশুটির নাম রাখা হলো মেঘা। সে সারাক্ষণ মাঝির সাথে থাকতে ভালোবাসে। মাঝি কৌশলে তাকে গামছা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে নৌকা চালায়। মেঘা মাঝির কোলে হাসেকাঁদেআধো আধো স্বরে বোল তোলে।

যেদিন মেঘার মুখে কথা ফোটেসে মাঝিকে বাবা বলে ডাক দেয়। মাঝির চোখ দিয়ে গড়িয়ে আসে অশ্রু। এ অশ্রু আনন্দের। বাবা ডাক শুনতে পাবার।

ধীরে বড় হতে থাকে মেঘা। তাকে ভর্তি করানো হলো স্কুলে। সে বেশ মেধাবী। ছড়া জানে, লিখতে জানে। গল্প বলতে জানে। স্কুলে রোজ পড়া শিখে আসে। স্যারেরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে।

মেঘা সত্য বলতে ভালোবাসে। কোনো অন্যায় চোখে পড়লে প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। বয়স তার ছয় কী সাত হলো। পড়াশোনার ফাঁকে মাঝিকে ঔষধ খাওয়াতে জানে। স্নেহমাখা শাসন করতে জানে। সে বেশ ছুটতে জানে। সাঁতার কাটতে জানে। চোখের সামনে দুজনের ঝগড়া হতে দেখলে থামাতে জানে। বলতে গেলে অনেক কাজের কাজী সে।

একদিন হলো কী! শহর থেকে একদল লোক এসেছে। নদী ভাঙা এলাকার অবস্থা দেখতে। নদী পাড় ভাঙতে ভাঙতে শান্তিপুর গ্রামের খুব কাছে চলে এসেছে। যেকোনো দিন গ্রামটি নদীতে তলিয়ে যাবে। মাঝির ঘরখানা নদীমুখে ঝুঁকে আছে। মেঘা জানতে পেরেছে লোকগুলি বিভিন্ন পেশার। তারা কেউ সাংবাদিক, কেউ লেখক, কেউ প্ল্যান দেন। তারা গাঁয়ের এপাশ ওপাশ ঘুরে নদীর অবস্থা দেখতে থাকে। গ্রামবাসী কেবল নীরব দর্শকের মতো এদের ঘিরে আছে।

সকাল প্রায় এগারটা। মেঘা ছুটে আসে। তাদের সামনে দাঁড়ায়। বলেআমাদের গ্রাম যেদিন তলিয়ে যাবে সেদিনও বুঝি আপনারা দেখে চলে যাবেন। শান্তিপুর বিলীন হবার পথে। এ গ্রামটি রক্ষা করুন। ছোট মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে তারা অনেকটা অবাক। মেঘা আবার বললোচলুন সবাই মিলে কিছুৃ করি ক্রমে লোকেরা শহর থেকে ইট আনালো, পাথর আনালো, আরো লোকজন আনলো। সবাই মিলে গ্রামরক্ষায় যোগ দেয়। এদের সাথে যোগ দেয় শান্তিপুর গ্রামবাসী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড় নদী রক্ষায় ২৫ সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রত্যন্ত দ্বীপের কাহিনি