জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সরকার; তবে সেটি সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করার কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মাহফুজ আলম। এদিন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিষয়ে তুলে ধরতে তারা সংবাদ সম্মেলনে আসেন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিফ্রিংয়ের সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিফ্রিংয়ে সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক থাকার কথা তুলে ধরে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সংস্কার কমিশন থেকে প্রস্তাব আসবে, জনগণ কথা বলবে। চূড়ান্ত সংস্কারের প্রস্তাবনা হবে। সেই মোতাবেক যে পদক্ষেপ নেওয়ার তা নেব। আমরা বারবার বলেছি যত দ্রুত সম্ভব জরুরি সংস্কারগুলো শেষে নির্বাচনের তারিখ জানিয়ে দেব।
নির্বাচনে যাওয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ মন্তব্য করে তিনি বলেন, একই সঙ্গে তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) সংস্কারের বিষয়ে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। তারা (রাজনৈতিক দল) কখনও কখনও বলছে একটা সময় দিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই সময়টার ব্যাপারে আমরা অবস্থান নিতে পারছি না এইজন্য যে সংস্কার প্রস্তাব কী আসবে, সংস্কারে কতটুকু সময় লাগবে, এটা না জেনে নির্বাচনের সময় বলে দেওয়া যাচ্ছে না। বারবার বলা হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে দেওয়া হবে। দায়িত্ব নিলে নানামুখী চাপের মুখোমুখি হতে হবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নভেম্বর না করে জানুয়ারিতে করলেও একই প্রশ্নের সম্মুখীন (রাজনৈতিক দলের চাপ) হতাম। নির্বাচন কমিশন করতে হবে করা হয়েছে, এটা একটা নিয়মতন্ত্রের বিষয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই করা হয়েছে, কোনো চাপে করা হয়নি। দাবিটা নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নয়, নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ নিয়ে। এসময় আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ বলেন, নির্বানের বিষয়টি সরকারের নজরে আছে বলেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সংস্কার, যেজন্য বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়েছে। সংস্কারের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হওয়ার পরেই নির্বাচন হবে। সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই এটা ঠিক হবে।
মাহফুজ আলম বলেন, বাংলাদেশে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আছে এবং এখানে ইসকন অথবা ইসকনের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই এখানে জড়িয়ে পড়েছেন। এবং এছাড়াও বাংলাদেশের একটা বড় জনগোষ্ঠীর ভেতরে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, সরকারের পক্ষ থেকে যিনি নিহত হয়েছেন সেই বিষয়ে যে মামলা চলমান আছে, দুটি মামলা হয়েছে আরো মামলা হওয়ার কথা রয়েছে। গ্রেপ্তার চলমান থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকার উদ্যোগ নিয়েছে যাতে অপরাধীরা কোনোরকম ছাড় না পায়। সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা তৈরির যেই একটা অপচেষ্টা ছিলই; (সেই) অপচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ সবগুলো রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় কমিউনিটি সবাই মিলে এটা রুখে দিয়েছে। এই বাস্তবতায় গতকাল (বুধবার) বিএনপি নেতৃবৃন্দ দেখা করেছেন এবং আজকে জামায়াতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ দেখা করেছেন। দুটি দল থেকেই সামগ্রিক ঐক্য এবং বাংলাদেশের অখণ্ডটা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় এবং যে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং উগ্রতা কিভাবে রুখে দেওয়া যায় উন্মত্তটা কীভাবে রুখে দেওয়া যায় এই সম্বন্ধে সকলের সহযোগিতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কামনা করেছেন এবং দুটি দলই সরকারকে সহযোগিতা করতে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
আগামীতেও সাম্প্রদায়িক উশৃঙ্খলা রুখতে সরকার সব অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলবে বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা বিশেষ করে আমরা লক্ষ্য করছি যে এই শুধুমাত্র ইসকনের ইস্যুটাই নয়, মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মাজারে হামলার ঘটনা আমাদের নজরে আছে এবং বাংলাদেশের যেখানেই গত দুই তিন মাসে যেভাবেই বা আমাদের হামলা হয়েছে এবং গত দুই দিনে হয়েছে এগুলো আমাদের নজর আছে এবং আমরা এগুলো খুবই গভীর নজরে দেখছি এবং আমরা আশা করি যে খুব স্বল্প সময়ের ভিতরে আমরা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিব যাতে যারা এই মাজারে হামলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা যাতে এক ধরনের প্রতিকার পান।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে রাজনৈতিক দলের দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহফুজ আলম বলেন, তাদের প্রস্তাবনা সব অংশীজনদের সঙ্গে বসার জন্য যাতে কমিউনিকেশন গ্যাপ না থাকে। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। সামনের দিনেও যোগাযোগ করব। সব ধরনের স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে যাতে করে জাতীয় ঐক্য, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যায় সেই পরামর্শ সবাই দিয়েছেন।এই পরামর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ঐক্য। সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যাতে আমরা কথা বলি। এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক।
আরেক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কোনো সংস্থা নিষিদ্ধ করার আলোচনা সরকারের মধ্যে হয়নি। দাবি অনেক উঠতে পারে, দাবির স্বপক্ষে মানুষ অনেক কর্মসূচিও দিতে পারে। ব্যক্তির অপরাধের সঙ্গে সংস্থার অপরাধ আমরা জড়িয়ে ফেলছি না। একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার ব্যাপারে একটা আইনি প্রক্রিয়া চলছে। তিনি অপরাধী হতেও পারেন, নাও হতে পারেন–সেটা আদালত দেখবে। আজকেও পত্রিকায় দেখলাম ইসকন বলেছে যে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের সঙ্গে ইসকনের কোনো সম্পর্ক নেই।
উস্কানি এলেও দেশের মানুষ তাতে প্ররোচিত হবে না বলে মনে করেন তিনি। বলেন, আমরা সত্যিকার অর্থে সম্প্রীতিটা স্থাপন করে দেব। এ জন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, দাবি–দাওয়া নিয়ে সব সময় আলোচনা করব। প্রতিটি অপরাধের বিচার হবে। অপরাধের বিচারের সঙ্গে সম্প্রীতিটা মিলিয়ে পেলে চলবে না। সম্প্রীতির বন্ধব যাতে আরও দৃঢ় হয় সে জন্য সরকার কাজ করবে। এসময় মাহফুজ বলেন, সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে অনুযায়ী মামলা চলমান। এটি বিচারাধীন বিষয়। আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে সেটি কীভাবে অগ্রসর হবে।
চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়ক এবং রাজধানীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের গাড়িতে একাধিকবার ট্রাকের ধাক্কা দেওয়ার দাবির বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, সমন্বয়কদের উপর হামলার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সমন্বয়করা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতিকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালাচ্ছেন, তাদের বিবেককে যেভাবে জাগ্রত করছেন, এটা নিশ্চয়ই অনেকের সারতে লাগবে। তাদের নিরাপত্তা বিষয়টি পরিষদে আলোচনা হয়েছে। তাদের যে নিরাপত্তার প্রয়োজন, এটা আলোচিত হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটার বিষয়ে সরকারের সংস্থাগুলো তদন্ত করছে।