জরুরি বিভাগে জরুরি চিকিৎসাসেবায় নতুন যুগে প্রবেশ করল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। জরুরি বিভাগের স্থলে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে গতকাল শনিবার নতুন যাত্রায় পা রাখল হাসপাতালটি। শিক্ষা উপমন্ত্রী ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর আগে সংস্কারের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনা হয় চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগের স্থলে নাম রাখা হয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার। শুধু নাম নয়, পাল্টে যাচ্ছে সেবার ধরনও। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আদলেই এখানে চিকিৎসাসেবা পাবেন রোগীরা। উদ্বোধনের পর গতকাল শনিবার থেকেই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের সেবা চালু হয়েছে।
হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের অভজারেভশন সেলে ৫০টিসহ রোগীদের জন্য সব মিলিয়ে ৮০টি শয্যা রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা চিকিৎসাসেবায় স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার। এছাড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্যও রাখা হয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
জরুরি রোগ নির্ণয়ে যুক্ত করা হয়েছে বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম। এর মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম, ইকো কার্ডিয়াগ্রাম, পোর্টেবল এক্স-রে, ইসিজি ও এনালাইজারসহ বেশ ক’টি সরঞ্জাম রয়েছে। চিটাগং ক্লাবের পক্ষ থেকে এসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। শয্যাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়েছেন ক্লাবটির সদস্যরা। এখন জরুরি বিভাগেই এসব পরীক্ষার সুবিধা পাবেন রোগীরা। এসব পরীক্ষার জন্য আগের মতো ওয়ার্ডে, প্যাথলজিতে ঘুরতে হবে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবায় মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক এবং অ্যানেসথেসিয়াসহ প্রয়োজনীয় সব বিভাগের একজন করে কনসালটেন্ট সার্বক্ষণিক (শিফট ভিত্তিতে) নিয়োজিত থাকবেন এখানে। চিকিৎসকদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষ। এছাড়া দুটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও পর্যায়ক্রমে ৪টি আইসিইউ শয্যা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে।
হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, একজন রোগী আসা মাত্রই এখানে রাখা হবে। চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করবেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হলে সেটাও এখানে করা হবে। রোগীদের ২৪ ঘণ্টার মতো এখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এর মধ্যে যেসব রোগীর আর চিকিৎসা প্রয়োজন হবে না বা বাসায় চিকিৎসা নিতে পারবেন, তাদের বিদায় করে দেওয়া হবে। যেসব রোগীর আরো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, শুধু সেসব রোগীকেই আন্তঃবিভাগে ভর্তি দেওয়া হবে। মোট কথা, একজন রোগী জরুরি বিভাগে আসার পর জরুরি সব ধরনের চিকিৎসা যাতে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে পান, সে আয়োজন করা হয়েছে।
চমেক হাসপালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির, চিটাগাং ক্লাবের চেয়ারম্যান নাদের খান, চমেক অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তার, বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান, চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ হাসান চৌধুরী, সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক ও চিটাগং ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান মনজুরুল হক মনজু।
এছাড়া জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি, মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুযত পাল, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. আশিষ দে, হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলামসহ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনকালে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, দেশে আর কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এভাবে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার হয়নি। কিন্তু আমাদের এখানে চালু হলো। আমি মনে করি এটি একটি যুগান্তকারী কাজ। খুব দরকারি উদ্যোগ। এটাকে ধরে রাখতে হবে। কারণ এখানেই যদি আমরা রোগীদের প্রাথমিক স্ক্রিনিংটা সেরে ফেলতে পারি, তাহলে হাসপাতালে ভর্তির যে চাপ সেটা অনেকাংশে কমে যাবে। এখান থেকে অনেক রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা, এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিয়ে প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টা রেখে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যাপক বিনিয়োগ চলছে, বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে এটা সম্পাদিত হয়েছে। এখানে জনবলের একটা চ্যালেঞ্জ আছে, সেটা শীঘ্রই নিরসন হবে বলে আমরা আশাবাদী। এই সেবা চালুকরণে চিটাগং ক্লাবের সম্মানিত সদস্যরা বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। এভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহল ও বিত্তশালীরা এগিয়ে এলে সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা অনেকদূর এগিয়ে যাবে। চিত্রটা পাল্টে যাবে। এতে করে সাধারণ মানুষই উন্নত মানের সেবাটা পাবেন। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে হাসপাতালের পরিচালকসহ যারা সহযোগিতা করেছেন সকলকে ধন্যবাদ জানান নওফেল।
স্বাগত বক্তব্যে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার স্বাস্থ্যসেবার অপরিহার্য অংশ। ঢাকা সিএমএইচে চার বছর ধরে এটা চলছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাইলটিংভাবে চালু আছে। তবে সরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এটাই প্রথম। এখানে ইমার্জেন্সি সার্ভিসের পাশাপাশি সপ্তাহে সাত দিন/২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ সেবা পাওয়া যাবে। রোগী আসার সাথে সাথে ডায়াগনসিস দ্রুততম সময়ে হবে। এর মাধ্যমে ইনডোরে ভর্তি রোগীর যে চাপ তা কমে আসবে। বর্তমানে ইনডোরে প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের সেবা চালুর মাধ্যমে সেটি এক হাজারে নেমে আসবে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, এখানে রোগীরা সন্তুষ্টি পাবেন। কারণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাদের দেখবেন। আবার ইনডোরেও রোগীরা ভালোভাবে সেবাটা পাবেন। কারণ, রোগী কমে গেলে সীমিত জনবল দিয়ে সেবাটা ভালোভাবে দেওয়া যাবে। সর্বোপরি দালালের দৌরাত্ম্য কমবে। পত্রিকায় দেখি, অনেক সময় প্যারাসিটামল ওষুধও কিনতে হচ্ছে রোগীদের। এটি শুনলে হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে আমার লজ্জা লাগে। ওষুধের মিনি স্টোর ওয়ান স্টপে থাকবে। একটি ডিজিটাল ডিসপ্লে থাকবে। সেখানে হাসপাতালে কি কি ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া যায়, তার তালিকা থাকবে। এতে করে মানুষ সহজেই জানতে পারবেন, হাসপাতালে থেকে তার কি কি ওষুধ পাওয়ার কথা। এখানে হাসপাতাল প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা থাকবেন। তিনি রোগীদের অভিযোগ শুনবেন এবং সমাধানে ব্যবস্থা নেবেন।
চমেক হাসপাতালের বিদ্যমান জনবল দিয়ে এটি চালু করা হলেও আলাদা জনবল চেয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক। চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানোয় চিটাগং ক্লাবের চেয়ারম্যান নাদের খানসহ সম্মানিত সদস্যদের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
চিটাগং ক্লাবের চেয়ারম্যান নাদের খান বলেন, দেশের সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা কম। এজন্য এসব হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে মানুষ তেমন একটা আসতে চায় না। কিন্তু এই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার চালুর মাধ্যমে মানুষের ধারণাটা পাল্টাবে বলে আমরা আশাবাদী। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। আর এই উদ্যোগে আমাদের শামিল করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।