ঘুষের প্রায় ৯৪ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিমের বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলায় একে একে বেরিয়ে আসছে রথি মহারথীদের নাম। সার্ভেয়ার ও দালালসহ গ্রেপ্তার হওয়ার চারজনের দেওয়া স্বীকারোক্তি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসা প্রভাবশালী দালালের তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, ব্যাংক কর্মকর্তা, সাংবাদিকের নামও। এসব দালালের সাথে জমি ক্ষতিপূরণ দুর্নীতির সম্পৃক্ততা মিলেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক ৫৭জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম। এ ব্যাপারে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলার তদন্তের এ পর্যায়ে প্রায় দেড়শ দালালের নাম পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে দালালদের নাম প্রকাশ করেছে। এতে জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনজীবীদের নাম রয়েছে। এখন যাচাই বাছাই করে অনেকের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। অনেকের জমি এটাচ (মামলায় সম্পৃক্ত) করা হয়েছে। একই সাথে জেলা প্রশাসনের অনেক অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উঠে এসেছে।’
আদালত ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি র্যাবের অভিযানে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান। ওই ঘটনায় ১০ মার্চ চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে সার্ভেয়র মো. ওয়াসিম খানকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন। তিনি মামলাটির তদন্তভারও পান। এরপর মামলা তদন্তে নেমে ২২ জুলাই কক্সবাজারের শীর্ষ দালাল সেলিম উল্লাহ এবং ৩ আগস্ট দালাল সালাউদ্দিন ও কামরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ এলএ মামলার মূল নথি, ঘুষ লেনদেনের হিসাব লেখা রেজিস্ট্রার উদ্ধার করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসব নথি থেকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা এবং লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। পরে গ্রেপ্তার হওয়া সার্ভেয়ার ও তিন দালালকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামি পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই স্বীকারোক্তিতে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ লেনদেনে উঠে আসে প্রায় দেড়শ দালালের নাম। এসব দালালদের মাধ্যমে কমিশনে জমির ক্ষতিপূরণ ছাড় দিয়েছেন এলএ শাখার কর্মকর্তারা। আসামিদের স্বীকারোক্তিতে ক্ষতিপূরণ লেনদেন কাজে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ৫৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে আসে। তন্মধ্যে ৩০জন সার্ভেয়ার, ৮ জন কানুনগো, ১০ জন অফিস সহকারী, ৩ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, ৫ জন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’র নাম। আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসে, কাকে, কিভাবে কমিশনের টাকা দিয়েছেন। জব্দকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনা করেও টাকা লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হন তদন্ত কর্মকর্তা।
আসামিদের জবানবন্দিতে এলএ শাখার জমির ক্ষতিপূরণ দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার তালিকায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আবসারের নাম আসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এটি তদন্তাধীন বিষয়। আমার নাম আসলে তদন্তের মধ্যে আসবে। এ বিষয়ে বক্তব্য আমি দিব না।’ অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবসময় যাচাই বাছাই করেই এলএ চেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। নিয়ম মেনে আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।’
দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসা দালালদের মধ্যে রয়েছে, ইনানীর মহিবুল্লাহ, আহমদ হোছন, জসিম উদ্দীন, আরিফুর রহমান, হোঁয়ানকের সাবের মোহাম্মদ ইবরাহীম, আমান উল্লাহ, কালারমার ছড়া এলাকার নোমান শরীফ, জালাল উদ্দীন, জসিম উদ্দিন, তারেক, জাকারিয়া, নুরুল আমিন, মাস্টার আব্দুল গাফফার, মৌলভী জাকারিয়া, সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও তাঁর ছেলে মেহেদী, মো. সালাউদ্দীন, মো. কামরুদ্দীন, ক্যাচিং মং, ওমর সিদ্দিক লালু, জাভেদ মো. কায়সার নোবেল, আলমগীর, মাসেদুল হক রাশেদ, কায়সারুল হক জুয়েল, সিরাজুম মোস্তফা, মাতারবাড়ীর নাসির উদ্দীন মো. বাবর চৌধুরী, মোহাম্মদ হোসেন, হেলাল উদ্দীন, মোস্তাফিজুর রহমান, মামুন, রেজাউল, ওয়ালিদ চৌধুরী, নুরুল হুদা কাজল, আহম্মদ উল্যাহ, রেজাউল করিম আশেক, মোহাম্মদ মামুন, আবদুছ সাত্তার, চিকনী পাড়ার নুরুল ইসলাম বাহাদুর, ধলঘাটার আবু ছৈয়দ, তাজ উদ্দীন, রমজান আলী, মোহাম্মদ হোছন, কামরুল ইসলাম, ঈদগাঁওয়ের তৈয়ব, ঝাপুয়ার খোরশেদ আলম, তোফায়েল আহমদ, সাইফুর রহমান শাহীন, নোমান শরীফ, সাইয়েদ হোছেন, আনছারুল করিম, মোসলেম উদ্দীন, ফখরুল ইসলাম, নুরুল হক, দুলাল, জেলা প্রশাসনের সহকারী ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর সহকারী কুতুবী, জয়নাল আবেদিন ও ব্যাংক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের নাম।
দুদকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কক্সবাজার জমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে জেলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় সাংবাদিক এবং দালালদের কয়েকটি জোট রয়েছে। যারা কক্সবাজারের সরকারি জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ লেনদেনের মাধ্যমে কমিশনের মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন দালালের ব্যাংক হিসেবের টাকা, ফ্ল্যাট, জমি জব্দ করেছে দুদক।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলাজুড়ে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি ২১টি প্রকল্পের জন্য প্রায় ২৮ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে রয়েছে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, সাবমেরিন বেস, রেল ট্র্যাকস, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, পিবিআই কার্যালয়, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প।
এদিকে গ্রেপ্তার সার্ভেয়র ওয়াশিমের ওই মামলা দুদক তদন্ত শুরু করলে কক্সবাজার জেলা জুড়ে এল এ শাখার দালালদের মধ্যে আতংক শুরু হয়। অন্যদিকে সরকারী এসব প্রকল্পের মধ্যে খাস খতিয়ানের বন্দোবস্তকৃত জমিও অধিগ্রহণ করার অভিযোগ উঠলে চলতি সপ্তাহে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসক।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন গতকাল বুধবার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কক্সবাজার ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার স্থাপন প্রকল্পে বন্দোবস্তকৃত সরকারি খাসজমিও অধিগ্রহণ হওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি তদন্তের জন্য এক সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সার্ভেয়র গ্রেপ্তারের মামলায় আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম উঠে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম আসলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত দায়।’