জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী: কাট্টলী অঞ্চলের আলোকবর্তিকা

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১২ মার্চ, ২০২৪ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ শাসনের প্রারম্ভে নওয়াব রেজা খাঁর আমলে চট্টগ্রামের সিংহভাগ সম্পত্তির মালিক ছিলেন, চট্টগ্রামের বিখ্যাত জমিদার বাড়ি ‘নাজির বাড়ি’র প্রতিষ্ঠাতা/ আদি পুরুষ মোহাম্মদ হাসেম নাজির খাঁন চৌধুরী। মোহাম্মদ হাসেম নাজির খাঁন চৌধুরীর পৌত্র ও আবদুল সৈয়দ চৌধুরীর পুত্র জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল চট্টগ্রামের বিশাল কর্ণেল হাট দিঘী (যার একাংশ ভরাট করে বর্তমানে ‘প্রশান্তি আবাসিক এলাকাস্থাপন করা হয়েছে)। জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর বড় পুত্রের কনিষ্ঠ সন্তান আমার আব্বা ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ বদিউল আলম চৌধুরী।

উল্লেখ্য, জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী ২৫ বছর বয়সে রেঙ্গুনে ব্যবসা আরম্ভ করেন। তিনি অবিভক্ত ভারতের প্রথম জাতীয় শিপিং লাইন ‘বেঙ্গলবার্মা স্টীম নেভিগেশন কোম্পানী লিমিটেডএর ডাইরেক্টর ছিলেন। তিনি বহু জনহিতকর কাজে জড়িত ছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম, চট্টগ্রামে বিশেষ করে কাট্টলী অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া, চিকিৎসা সুবিধা বিনামূল্যে, সহজে ও কম সময়ে পাওয়ার ব্যবস্থা করা, ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করে দেয়া, এমন আরো অনেক। এই জনহিতকর কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর দানকৃত ১৬ শতক জমির ওপর ১৯০৯ সালে ‘কর্ণেল হাট মধ্যম ইংরেজী স্কুল‘ (পরবর্তীতে কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী হাই স্কুল এর ‘প্রাইমারী সেকশন‘), ২৪ শতক জমির ওপর ১৯২৪ সালে ‘হাশিম নাজির দাতব্য চিকিৎসালয়‘ (বর্তমানে ২৫ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল), ৪০ শতক জমির ওপর একই সময়ে ‘কর্ণেল হাট‘ (পরবর্তীতে কর্ণেল হাট কাঁচা বাজারের বহুতল ভবন), ২৫ শতক জমির ওপর ১৯৪১ সালে কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী স্কুল প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ছাত্রছাত্রীদের সুস্থ শরীর ও মনের বিকাশ এবং খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হওয়ার জন্য ঢাকা ট্রাঙ্করোডের পশ্চিম পাশে স্কুলকে আলাদাভাবে খেলার মাঠও দান করেন। উল্লেখ্য, জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর জেঠাত ভাই এর ছেলে নজির আহমদ চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯১০ সালে ‘নাজির বাড়ি’র প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাজির বাড়ি বালিকা বিদ্যালয়’, যখন সারা বাংলায় নারী শিক্ষার কথা কেউ চিন্তাই করতে পারতো না। এ স্কুল ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পৃথক সত্তা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে আমির হোসেন চৌধুরীর বদান্যতায় ‘কাট্টলী ইংরেজী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হলে ‘নাজির বাড়ি বালিকা বিদ্যালয়এ স্কুলের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।

জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জমি দান করার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষায়ও বিশাল অবদান রাখেন। তিনি তাঁর কয়েকজন নিকট আত্মীয়ের ভবিষ্যত আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরীর জন্যও জমি দান করেন। তাঁর সেই নিকট আত্মীয়দের সকল উত্তরাধীকারীদের সম্মিলিত উদ্যোগের ফসল চট্টগ্রামের কাট্টলীতে নবনির্মিত ‘চৌধুরী শপিং কমপ্লেক্স’। এটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ, শুক্রবার। আমার গ্রেটগ্র্যান্ডফাদার দাতা ও সমাজসেবী জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর দানকৃত জায়গার ওপর নবনির্মিত ‘চৌধুরী শপিং কমপ্লেক্স এর একজন ক্ষুদ্র অংশীদার হতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। কেননা, আমার আব্বা ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ বদিউল আলম চৌধুরী মাত্র ১(এক) বছর বয়সে তাঁর পিতাকে হারান এবং বেড়ে ওঠেন তাঁর দাদা জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। মৃত পুত্রের দুই ছেলের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী তাঁর ইন্তেকালের আট বছর আগে ১৯৩৮ সালে তাঁর দুই নাতির নামে সম্পত্তি ‘হেবা’ করে না দিলে আজ আমি এ সৌভাগ্যের দাবীদার হতে পারতাম না। কেননা, ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন জারী হওয়ার আগে মৃত সন্তানের ওয়ারিশগণের সম্পত্তির অংশ পাওয়ার সুযোগ ছিলনা।

দূরদর্শী ও বিচক্ষণ জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী এতিম দুই নাতির পাশাপাশি তাঁর নিকট আত্মীয়দেরও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে সমাজ বিনির্মাণে বিশাল অবদান রেখে গেছেন। কাট্টলী অঞ্চলের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসাবাণিজ্য ও সামাজিক সুরক্ষা) কর্মকান্ডে প্রচারবিমুখ দাতা ও সমাজসেবী এবং দূরদর্শী ও বিচক্ষণ জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর অবদানকে স্মরণীয় করে

রাখার জন্য আমার আব্বা ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ বদিউল আলম চৌধুরী তাঁর দাদার নামে কাট্টলীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়েজ আলী চৌধুরী মেমোরিয়াল কিন্ডারগার্টেনএবং তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উক্ত কিণ্ডারগার্টেনটির স্বপ্নময় যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। জানিনা, আমার গ্রেটগ্র্যান্ডফাদার জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর জন্য আব্বার মতো কিছু করার সুযোগ আমি পাবো কিনা! তবে আমার নিত্যকার দোয়ায় তিনি আছেন বহুবছর ধরে, যে শিক্ষা আমি আমার আব্বার কাছ থেকে পেয়েছি।

আমি আমার পূর্বপুরুষ জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ তাঁর সকল ভালো কাজ কবুল করুন এবং জান্নাতের সুউচ্চ জায়গায় তাঁকে স্থান দিন। আমিন।

তথ্যসূত্র: () প্রতিষ্ঠাতাদের পরিচিতি, কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী হাই স্কুল, ১৯৯০ এবং () প্রতিষ্ঠাতাদের স্মরণে স্মারকগ্রন্থ, কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়, ২০০৬।

লেখক: জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরীর প্রপৌত্রী, সরকারি কর্মকর্তা,

অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলহীন চোখের মানুষের মনে কখনও ফুল ফোটে না
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় কৃষি জমির টপসয়েল কাটার দায়ে যুবককে জরিমানা