জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা হচ্ছে না এবারও

১০ হাজার মৌসুমী ব্যবসায়ীর শত কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজনটি গত বছরের মতো এ বছরও গ্রাস করে নিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। বলীখেলার এ আয়োজনটি ১১২ বছরের ইতিহাসে এই নিয়ে পরপর দু’বার বন্ধ রাখতে হলো। বলীখেলা উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রায় ১০ হাজার ব্যবসায়ীর শত কোটি টাকার ব্যবসা আবারো পণ্ড হলো করোনার ভয়াল থাবায়। এ বছরও যে আয়োজনটি হচ্ছে না তা গত মার্চ মাসে সংবাদ সম্মেলন করে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা আয়োজক কমিটি জানিয়ে দেয়।
চট্টগ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। আয়োজনটি নগরবাসীকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। মঞ্চে বলীদের শক্তি আর কৌশলের লড়াই। চারপাশে হাজারো দর্শকের উল্লাস। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলি খেলার এই চিরচেনা ছবি গতবারের মতো এবারও দেখা যাচ্ছে না। একই ভাবে সারা বছর অপেক্ষায় থাকা চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের বৈশাখী মেলাও এবার বসেনি। তাতে চট্টগ্রামবাসী স্বভাবতই আশাহত। একই সাথে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মেলায় অংশ নেয়ার অপেক্ষায় থাকা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। কারণ শুধুমাত্র জব্বার মিয়ার বলী খেলা উপলক্ষেই সারা বছর ঋণ নিয়ে, ধারদেনা করে নানা ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করে থাকেন স্বল্প আয়ের মানুষগুলো। আয়োজক কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী আজাদীকে বলেন, গত বছর ১১১তম আসর হওয়ার কথা ছিল। এবছরও করতে পারি নি ওই একই কারণে। পরিস্থিতি এখন এমন উদ্বেগজনক পর্যায়ে আছে, প্রধানমন্ত্রী জনসমাগম এড়ানোর কথা বলেছেন। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, সারা বছর চট্টগ্রামের মানুষ অপেক্ষা করে থাকে এই মেলার জন্য। বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই বলীখেলা নিয়ে আলোচনা চলে। স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। থাকে বলীদের নানা খোঁজখবর। চট্টগ্রামের শতাধিক বছরের ঐতিহ্য সম্বলিত বলীখেলায় বলী হিসেবে অংশ নিতে খুশি মনে প্রস্তুত থাকেন শত মানুষ। বলীদের প্রেম আর সাধারণ মানুষের কৌতূহলই বাঁচিয়ে রেখেছে বলীখেলা। এটি শুধু খেলা নয়, বহু পুরনো ঐতিহ্যের স্মারক, যাতে পরপর দ্বিতীয় বারের মতো করোনা তার সর্বগ্রাসী থাবা বসালো।
মেলা আয়োজক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ জামাল হোসেন আজাদীকে বলেন, পুরো বাংলাদেশ থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এ মেলায় অংশ নিতে আসে। প্রায় প্রতিটি জেলার বিখ্যাত উপকরণগুলো নিয়ে দোকানিরা অংশ নেয় প্রাণের মেলায়। তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেলায় অন্তঃত দশ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অংশ নেয়, আর নগরীর ৬০ লাখ মানুষ মেলায় কিছু না কিছু কিনে। প্রত্যেকে গড়ে ২০০ টাকার বাজার করলেও এ ক্ষতি শত কোটি টাকার উপরে।
২০১৯ সালে লালদীঘির পাড় পেট্রোল পাম্প এলাকায় বসেছিলেন ঢাকার লালবাগের আনিসুর রহমান উজ্জ্বল। ধানমন্ডি থেকে মাটির সরা, হাঁড়ি নিয়ে এসেছিলেন ফিরোজ মিয়া। বগুড়া থেকে আসবাবপত্র নিয়ে এসে শহীদ মিনার এলাকায় বসেছিলেন আল আমিন, রফিকুল ইসলাম, মানিকসহ আরো কয়েকজন। এবারও আসার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু করোনার প্রভাবে তাদের মাথায় হাত। ওসমান আলী বলেন, আমি ২২ বছর ধরে মাটির জিনিস নিয়ে মেলায় এসেছি। আমার ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডে মূল প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রতিবছর বলীখেলায় আমি দোকান নিয়ে বসি। গতবারও পারি নি, এবারও আসতে পারলাম না।
খেলনা ব্যবসায়ী কলিম উল্লা গতকাল মোবাইল ফোনে আজাদীকে জানালেন, আমরা প্রতি বছর চট্টগ্রামের ওই মেলায় যোগ দিই। সেখানে বিক্রি বেশ ভালো- লাভও হয়। গতবছরও অপেক্ষায় ছিলাম। হয় নি বলে আরো বেশি আশা করেছিলাম এবছর। বেচা-বিক্রি ভালো হবেই আশা ছিল। কিন্তু করোনার জন্য সব শেষ হয়ে গেল।
তরুণ মৃৎ শিল্পী সুবোধ পাল সাভার থেকে এ বৈশাখী মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন ৫ বছর ধরে। সাভারে বসবাসরত এ মৃৎশিল্পী জানান, জব্বার সাহেবের বলী খেলার মেলা নিয়ে আমার পরিবারের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। বাবা অমর কৃষ্ণ পাল প্রায় এক যুগ ধরে এখানে ব্যবসা করেছেন। সুবোধ জানালো গত বছর প্রস্তুতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত পণ্ড হলো। এবছর ঘুরে দাঁড়াবেন ভেবে গত ছয় মাস ধরে তারা এ মেলায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এবারও ভগবান মুখ তুলে চাইলেন না।
মেলায় বিক্রির জন্য ঝাড়ু নিয়ে আসতেন চকরিয়ার নূর মোহাম্মদ। তিনি জানান, চকরিয়া থেকে বেশ কয়েকজন ঝাড়ুওয়ালা ট্রাক ভাড়া করে মেলায় আসতাম। শুধু আমরা নই, বাঁশখালী থেকেও আসতো অনেকে ঝাড়ু নিয়ে। মেলায় আসবো বলে খাগড়াছড়ি থেকে ঝাড়ুর ফুলগুলো কাঁচা নিয়ে আসি প্রতি বছরের মতো। এরপর শুকানো হয়। তারপর শ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন কোয়ালিটির ঝাড়ু তৈরি করা হয়েছে। সব শেষ হয়ে গেল।
চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা লোক সংস্কৃতি বিশ্বায়নের ফলে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ সংস্কৃতি হাজার বছরের ঐতিহ্য সম্বলিত। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলায় আর যেন ছেদ না পড়ে কখনো। সগৌরবে বেঁচে থাক এ মেলা হাজার বছর। এ লোক সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবেতো আমাদেরই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেফাজতকে অর্থ দিয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধতিনি ‘জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ তার অনেক গুণ