চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। নগরীর উত্তর কাট্টলীতে গত ১৮ মে অভিযান চালিয়ে একশ একর খাস জমি উদ্ধার করা হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩০টির মতো স্থাপনা। এসব জমির মধ্যে রয়েছে ১৫টি পুকুরও। সবমিলে উদ্ধারকৃত এসব সরকারি সম্পত্তির বাজার মূল্য ৭০০ কোটি টাকার উপরে। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দশকের পর দশক ধরে সরকারি দলের সাথে মিলে বিরোধী দলের প্রভাবশালী কিছু লোক সরকারের এসব খাস জমি দখলে রেখে ভোগ করে আসছিল। পাশে একই শ্রেণীর আরো দুইশ একর জমি রয়েছে। এর আগে উদ্ধার করা বিশাল আয়তনের জমিও রয়েছে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাটিতে। সবমিলে সমুদ্র উপকূল বেষ্টিত সম্ভাবনাময় ওই এলাকায় সরকারি খাস জমি রয়েছে ৭৫০ একর। আজাদীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমপ্রতি জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের চোখে পড়ে বিশাল আয়তনের জায়গা বেহাত হওয়ার বিষয়টি। পরক্ষণেই তিনি পুকুরসহ জমিগুলো উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন অত্র এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, উদ্ধারকৃত এসব জমিতে দখলদাররা মাছ চাষ, গরুর খামারসহ নানা ব্যবসা করে আসছিলেন। পার্কের মতো করে বিনোদন স্পটও করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত একশ একর এই জায়গার মূল্য প্রায় সাতশ কোটি টাকা বলে জানিয়ে তিনি বলেন, স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অনুপ্রবেশকারীরা যাতে সেখানে ফের প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ‘অনুপ্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ’ লিখা ১০ টি সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, খাস জমির দখলদারদের চক্র অনেক শক্তিশালী। এই খাস জমি উদ্ধারের জন্য যত শক্তিশালীই হোক– চক্রগুলো ভাঙতে হবে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, নানাভাবে চরের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। নেতা–এমপি, এনজিও মালিক, সবাই চরের খাস জমি দখল করে আছে। যারা এসব করে তাদের হাত অনেক লম্বা। এরা মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। তবু এদের কাছ থেকে জমিগুলো উদ্ধার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে সরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন, খাস, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও দপ্তরের মালিকানায় জমি রয়েছে। কিন্তু কোন্ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কী পরিমাণ কোন শ্রেণীর সরকারি সম্পদ রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায় না। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি আপিল বোর্ড, ভূমি সংস্কার বোর্ড, রাজউক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। সরকারি স্থাপনা নির্মাণ কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা সরকারি সম্পত্তিগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে সরকারি সম্পত্তি চলে যাচ্ছে জবরদখলকারীদের নিয়ন্ত্রণে। আবার সেই সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সরকার পক্ষ আদালতে মামলা করছে। সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পর সেই সম্পত্তি উদ্ধারে মামলা করা হলেও যেসব কর্মকর্তা–কর্মচারীর দায়িত্বহীন আচরণে সরকারি সম্পত্তি বেহাত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, পর্যাপ্ত অর্থ, জনবল ও আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পাওয়ায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা যায় না। এক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে উচ্ছেদ অভিযান পরিত্যাগ করতে হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্ছেদ অভিযানে বাধাদানকারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের প্রশংসনীয় ভূমিকা নগরবাসীর দৃষ্টিতে এসেছে। ইতোপূর্বে সীতাকুণ্ড এলাকায় সমপ্রতি প্রায় ১৯৪ একর সরকারি খাস জমি উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে, উত্তর কাট্টলীর সমুদ্র উপকূলে থাকা খাস জমি উদ্ধার করা হলো। এসব জমি নিয়ে জেলা প্রশাসনের রয়েছে পরিকল্পনা। জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে জানান, মেরিন ড্রাইভের পাশের উদ্ধারকৃত জমিসহ প্রায় ৭৫০ একর জমি নিয়ে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সংরক্ষিত বন, সাইক্লিং ট্র্যাক, বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের মতো অন্যান্য জেলা প্রশাসকও যদি এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খাস জমিগুলো চিহ্নিত করেন এবং উদ্ধারে তৎপর হন, তাহলে দেশ অনেক লাভবান হতো। সরকারি সম্পত্তিগুলো জবরদখলকারীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিতে হবে।