জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা তিনি আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব

| বুধবার , ৬ জুলাই, ২০২২ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদএর জন্মশতবার্ষিকী আজ।

দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের আহ্বানে তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি সৎ সাংবাদিতার ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার জগতে একজন পথিকৃৎ। রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার এক আলোকবর্তিকা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্বস্ত সহচর।

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন চট্টগ্রামে সাংবাদিক অঙ্গনের একজন আদর্শ। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদীর চেতনার একটি আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করেছেন আমৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাঁর অন্যতম ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে স্মরণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের অধিকারী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি ছিলেন পরমতসহিষ্ণু পুরুষ। অন্যের বক্তব্য তিনি মনোযোগ সহকারে শুনতেন, ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিতেন এবং কোনো পয়েন্টে বিরোধিতা করতে হলে যুক্তিনির্ভর আলোচনা করতেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, যা বিশ্বাস করতেনতাই বলতেন। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও আপাদমস্তক তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক। সব শ্রেণীর, সব ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল মমত্ববোধ। উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ বলতে যা বোঝায় অধ্যাপক খালেদ তা’ই। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা তাঁকে মহীরূহ করে তুলেছে, করে তুলেছে সর্বজন শ্রদ্ধেয়।

ভাষাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান বলেছেন : ‘প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ জীবিতকালেই প্রমাণ করলেন এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে তিনি শুধু কিংবদন্তিতুল্য এক মহান ব্যক্তিত্বই নন, তিনি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বোদয় উত্থানের পথে আশাপ্রদ ও অপরিহার্য অর্জন এবং আশ্রয়’। জীবিতকালে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যেমন আমাদের আশ্রয় ছিলেন, তেমনি মৃত্যুর পরেও ভূমিকা পালন করছেন পথ প্রদর্শকের। তাঁর অপরিসীম কল্যাণ ও শুভবোধ আমাদের উদ্দীপ্ত করে, তাঁর সততা ও কর্মনিষ্ঠ মনোভাব আমাদের প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে এবং মানুষের প্রতি মমতা ও দেশজাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধ থাকার অন্তর্গত প্রেরণা আমাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ করে তোলে। তিনি আমাদের আলোকিত পুরুষ ও আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর আগেও, মৃত্যুর পরেও।

ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন অসামান্য ও অতুলনীয়। ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজের মানুষের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। ব্যক্তিচরিত্রের মূল্যায়ন করেছেন আমাদের অনেক লেখক তাঁর জীবদ্দশাতেই। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে সামাজিক দায়বদ্ধ যথার্থ সমাজদরদী ও পরহিতব্রতী’। ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম লিখেছিলেন, অধ্যাপক খালেদের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে দেখা হতো। দেখতাম একজন রুচিশীল ভদ্র এবং নম্র স্বভাবের লোক, বক্তৃতা করেন ধীরে, বিষয়বস্তুর আলোকে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট।’ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান লিখেছেন, নিয়মানুবর্তিতা তাঁর জীবনের এক বিশেষ গুণ। যে কোনো সভাসমিতিতে তিনি সময়মতো হাজির হতেন। তিনি মানুষকে বড় করে দেখতেন। তাঁর কাছে সবাই যেন বড়।’ সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়া লিখেন, মানুষের জন্যই তিনি সবসময় নিবেদিত। সেই মানুষ কোন্‌ সম্প্রদায়ের তা কোনোদিন চিন্তা করেন নি। মানুষের বিপদে আপদে ছুটে গেছেন তিনি কষ্ট স্বীকার করে। রাউজানে বড়ুয়া পাড়ার এক গৃহস্থের ধান খেয়েছে প্রতিবেশী এক মুসলিম গৃহস্থের ছাগল। এ নিয়ে বিবাদ, মারামারি। এমন কি দাঙ্গা বাধার উপক্রম। রাউজান জ্ঞানানন্দ বিহারের অধ্যক্ষ প্রিয়ানন্দ মহাথের আমাকে নিয়ে প্রফেসর সাহেবের বাসায় উপস্থিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশ সুপারকে ফোন করে স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়ে সেদিন দাঙ্গা রোধের ব্যবস্থা করেন এবং পরবর্তীকালে সালিশের মাধ্যমে তিনি তার মীমাংসা করেন। অদ্রীশ নামে খ্যাত কলাম লেখক মোহাম্মদ ইদ্রিস লিখেছেন, আবদুল হক চৌধুরী ও আসহাব উদ্দিন আহমেদদু’জনকেই দেখেছি খালেদ সাহেব সম্বন্ধে আন্তরিক ও প্রীতিময় কথা বলতে। খালেদ নামক মানুষটি নিজেকে কখনো বড় বা সৎ বলে জাহির করেন নি। নিজের অজান্তেই স্বতঃস্ফূর্ত লোকপ্রিয়তায় তিনি দেশ ও দশের নিকট বড় হয়ে উঠেছেন। নাট্যকার অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক লিখেছিলেন, নির্লোভ অনাড়ম্বর জীবন সাধনায় ব্রতী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমার অসম্ভব প্রিয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁর দুর্লভ সান্নিধ্যস্মৃতি আমাকে আজীবন সঙ্গ দেবে। প্রাবন্ধিক অজয় দাশগুপ্ত লিখেছেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, বক্তা। সবার উপরে আমার অগ্রজ পিতৃসম বন্ধু। তারও ওপরে হৃদয়বান ভদ্রলোক। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ইতিহাসে কীর্তিমান। বাকশালের গভর্নর বলে নয়, আওয়ামী লীগ নেতা বা আজাদীর কারণে যতটা, তারচে বেশি একটি কারণে। এই সৌম্য দর্শন উত্তেজনাহীন মানুষটির কাছে পরাস্ত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক শিরোমণি কুখ্যাত ফজলুল কাদের চৌধুরী। যে কারণে বাংলাদেশ, যে কারণে জয়বাংলা।’

আসলে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তি। তাঁর সুকুমার ও সুমার্জিত দিকটির অজস্র পরিচয় পেয়েছি। তাঁর বিদ্যা ও মনীষা গভীরতর ও তীক্ষ্ণতর। তিনি আমাদের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র