কিছুদিন আগে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন নিয়ে এক বন্ধু তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন বছরের শুরুতে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র জমা দিতে বলে। ২০১৪ সালে করা বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র জমা দিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটি গ্রহণ না করে নতুন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র আনতে বলে। পরে তিনি বাচ্চার নতুন জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রের জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে গেলে বাচ্চার জন্ম নিবন্ধনের আগে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর জন্ম নিবন্ধন প্রয়োজন বলে জানান। তিনি তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট রয়েছে বলে জানানোর পরেও নতুনভাবে জন্ম নিবন্ধন করতে বাধ্য হন। অথচ জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) থাকলে জন্ম নিবন্ধন সনদ লাগার কথা নয়।
যে কোনো দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতির জন্য সেই দেশের জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট এর যে কোনো একটি থাকা বাধ্যতামূলক। উন্নত বিশ্বে জন্মের সাথে সাথে শিশুরা জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র পেয়ে থাকেন। আমাদের দেশেও শিশু জন্মের পরই জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র পাওয়ার কথা। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশে জন্ম নিবন্ধন নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না, তাই এটির গুরুত্বও ছিলো না। তখন যারা এস এস সি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতো, তাদের এস এস সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় জন্ম তারিখ দিতে হতো। আর যারা পাসপোর্ট বানাতেন তারা জন্ম তারিখ দিয়ে পাসপোর্ট করিয়ে নিতেন। সে জন্য বেশীরভাগ মানুষের জন্ম তারিখ ছিলো ভুল। সেই অনিয়ম হতে রক্ষা, সকল নাগরিকের সঠিক জন্মতারিখের হিসাব রাখা ও মোট জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়ার জন্য সরকার ২০০৪ সালে জন্ম নিবন্ধন আইন পাস করে, যা ২০০৬ সাল হতে কার্যকর করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, চাকুরিতে নিয়োগ, ব্যাংক হিসাব খোলা, পানি গ্যাস টেলিফোন বিদ্যুতের সংযোগ, ট্রেড লাইসেন্স, পাসপোর্ট, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জমি রেজিস্ট্রেশনসহ ১৬টি মৌলিক সেবা পেতে জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। শুরুতে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। পরবর্তীতে ২০১০ সালের শেষের দিকে এসে তা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সে সময় জন্ম নিবন্ধনের সব তথ্য ডিজিটাল করা হয় নি। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার সব মানুষের জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হয় নি। এভাবে এক যুগ চলার পর নিবন্ধনের সক্ষমতা বাড়ানো ও দেশের সব মানুষকে জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য বছর খানেক আগে সরকার পুরানো সার্ভারের পরিবর্তে নতুন সার্ভার বসায়। তবে এই নতুন সার্ভারে আগের সার্ভারের সব তথ্য স্থানান্তর করা হয় নি। ফলে ২০১১ সালের আগে করা সব জন্মনিবন্ধন সনদসহ ২০১১ সালের পরে করা অনেক জন্ম নিবন্ধন সনদ বাতিল হয়ে যায়। সে জন্য এখন জন্ম নিবন্ধন সনদ পেতে মানুষের দীর্ঘ লাইন ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। নাগরিক সেবা সহজ করার জন্য যে জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র, সেটি পেতেই মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে সরকার বর্তমানে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আরো একটি নিয়ম যুক্ত করেছে। সেটি হলো যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর, তাদের সনদ পেতে হলে তাদের মা ও বাবার জন্ম সনদসহ জাতীয় পরিচয় পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। তবে জাতীয় পরিচয় পত্র থাকার পরেও জন্ম সনদ পত্রের প্রয়োজনীয়তা থাকার কথা নয়। কারণ ১৮ বছরের আগে জন্ম নিবন্ধন সনদ পত্রের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ১৮ বছরের পর জাতীয় পরিচয় পত্রের গুরুত্ব থাকে। কিন্তু আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে এখন অনেককে এটি নতুন করে করতে হচ্ছে। এদিকে বয়স্ক যারা নতুন করে জন্ম নিবন্ধন সনদ নিচ্ছেন তারা পড়ছেন আরেক সমস্যায়। কারণ তারা পুরানো জন্ম নিবন্ধনের নাম্বার দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন এবং ঐ পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। এখন তাদের আগের নাম্বারটি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আগের সার্ভারে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল। ফলে ফর্মের বাংলা অংশটি অনেকে ঠিকমত পুরণ করে নি। এখন তাদের আবার বাংলা তথ্য সংযোজনের জন্য দৌড়াতে হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান সার্ভারের সক্ষমতার চেয়ে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সার্ভার প্রায় ডাউন হয়ে যাচ্ছে। ফলে সময়মত জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র পেতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
অন্য দিকে জাতীয় পরিচয়পত্র (সংক্ষেপে এনআইডি কার্ড, যা আইডি কার্ড নামে বহুল প্রচলিত) হল বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক নথি, যা ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর নথিভুক্ত হতে হয়। তথ্য নথিভুক্ত করণ ও আইডি কার্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশে এনআইডি কার্ড প্রচলন শুরু হয় ২২ জুলাই ২০০৮ সালে। তখন দেশের সব নাগরিকের বাসা বাড়িতে গিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করা হয়। যাতে বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটিফিকেশনের মাধ্যমে সবার ছবি, আঙ্গুলের ছাপ ও স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তখন সকল বাংলাদেশী যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি তারা সকলে কেন্দ্রীয় বায়োমেট্রিক তথ্য ভাণ্ডারের সাথে সংযুক্ত হন, যা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন-নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। তবে ২০১৬ সালের পূর্বে সাধারণ আইডেনটিটি কার্ড সরবরাহ করা হত, যেখানে আইডিধারীর নাম, পিতা ও মাতার নাম, জন্ম তারিখ, আইডি নাম্বার, ঠিকানা, ছবি ও স্বাক্ষর উল্লেখ ছিল। পরে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইং ২০১৬ সালের অক্টোবরে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র উপস্থাপন করে। স্মার্ট কার্ডে একটি ইন্টারগ্রেট সার্কিট কার্ড (আইসিসি) সংযুক্ত আছে, যা চিপ্স কার্ড নামেও পরিচিত। স্মার্টকার্ডের চিপ্স, কার্ড মেশিনের সাহায্যে রিড করা যাবে। সেখানে নাগরিকের সব তথ্য সংরক্ষিত আছে। স্মার্ট কার্ডের ডিজাইনে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকগুলো যেমন মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পাখি, শাপলা ফুল, চা বাগান, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এনআইডি কার্ড করার জন্য এসএসসি বা সমমানের সার্টিফিকেটের ফটোকপি, জন্ম নিবন্ধ সনদের ফটোকপি, ইউটিলিটি বিলের কপি, নাগরিকত্ব সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পিতা, মাতা স্বামী/স্ত্রীর আইডি কার্ডের ফটোকপি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে এনআইডি বা স্মার্ট এনআইডি কার্ড হোল্ডাররা যে সকল সুযোগ-সুবিধা পান তা হলো : নাগরিক অধিকার ও সুবিধা সমূহ, লাইসেন্স, মটর যান রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট, জমি ক্রয় ও বিক্রয়, ব্যাংক হিসাব খুলতে, ব্যাংক ঋণ নিতে, টিন নাম্বার, মোবাইল সিম পেতে, সরকারি অনুদান ও ভাতা পেতে এবং চাকুরির আবেদন করতে। কয়েক বছর আগেও দেশে জন্ম নিবন্ধন সনদ ও এনআইডি করা অনেক সহজ ছিলো। কিন্তু জাল জালিয়াতি করে ভিনদেশি নাগরিক বিশেষ করে মায়ানমার নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট করে বিদেশে যাওয়ার পথ করে দেওয়ায় সরকার এতে কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে এখন এনআইডি কার্ড করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে কোনো নাগরিকের এনআইডি করতে হলে তার স্থায়ী ঠিকানায় তার নিজের নামে বা পৈতৃক স্থায়ী সম্পত্তি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে অনেকের স্থায়ী সম্পত্তি বিলীন হয়ে গেছে। ফলে দেশের স্থায়ী নাগরিক হওয়ার পরও তারা এনআইডি কার্ড পাবে না। এতে অনেকের ভোগান্তি বেড়ে গেছে ও নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে সন্তান জন্মদান বেশিরভাগই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকার যদি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে আদেশ জারি করে প্রতিদিনের জন্ম তথ্য সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদে পাঠাতে বাধ্য করে এবং তার ভিত্তিতে জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুর ব্যবস্থা করতে পারে। অন্যদিকে জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী যাদের বয়স ১৮ পূর্ণ হবে তাদেরকে নোটিশ জারী করে যদি তাদের সমস্ত তথ্য যাচাই, ফিংগার প্রিন্ট, ছবি ও স্বাক্ষর গ্রহণ করে এনআইডি দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তবে তা হবে সাধারণ নাগরিকের জন্য অনেক স্বস্তিদায়ক। এতে সময়ক্ষেপণ যেমন কমবে, অর্থের ও সাশ্রয় হবে এবং ভবিষ্যতে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচিত হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সংগঠক