জন্মদিনের কেকে স্ট্রবেরি থাকা চাই, ফ্রকে থাকতে হবে ফুল। ড্রইং রুমটা হরেক রঙের বেলুন দিয়ে সাজানো চাই-ই চাই। একাকী কেক কাটবে না। প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবীদের দাওয়াত দিতে হবে। জ্বলন্ত মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভাতেই চারপাশ থেকে সকলে বলে উঠবে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’; আর খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত কেক কেটে প্রথম টুকরোটা খাইয়ে দেবে বাবাকে, তারপর দেবে মাকে। সকলে যখন আয়াতের হাতে উপহার তুলে দেবে, তখন খুশি দেখে কে! এরপর মা-বাবাকে নিয়ে বেড়াতে যেত বাইরে। গত চার বছর ধরে ১৪ ডিসেম্বর আয়াতের জন্মদিন এভাবেই ধুমধামের সাথে পালিত হয়ে আসছে। এবারও মা-বাবার কাছে আগেভাগে নানা শর্ত দিয়ে রেখেছিল আয়াত। তার সকল শর্ত মেনে জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি ছিল পরিবারের। কিন্তু যাকে ঘিরে এ আয়োজন; সেই তো নেই। গত চার বছরের জন্মদিনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আয়াতের মা-বাবাকে। এ যে কতো দুঃসহ যন্ত্রণাময় স্মৃতি তা শুধু তারাই জানেন।
নগরীর ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকায় আয়াতের পরিবারের নিবাস। মা-বাবার একমাত্র সন্তান আলিনার জন্ম ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। প্রতিবেশীদের কারও শিশুসন্তান নেই। এ কারণে সবাই তাকে খুব আদর-স্নেহ করত। গতকাল বুধবার ছিল আলিনার পঞ্চম জন্মদিন। আয়াতের বাবা সোহেল রানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, কাকে নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটব? মেয়েই তো নেই। বুকের মানিককে ছয়-ছয়টি টুকরা করেছে খুনি। এবার জন্মদিনের পর নানাবাড়ি যাওয়ার বায়না করেছিল আয়াত। সেখান থেকে ফুপুর বাড়িতেও যাওয়ার আবদার ছিল তার। সোহেল রানা স্থানীয় একটি মুদি দোকানের মালিক। আবির ছিল তাদের ভাড়াটে।
আলিনা তাকে চাচ্চু বলে ডাকত। সোহেল রানা বলেন, কোনো দিন ভাবিনি, আমার মেয়েকে আবির খুন করবে। কীভাবে তার লাশ ছয় টুকরা করল? একটাই চাওয়া, আবিরের ফাঁসি। তিনি আরো বলেন, যত দিন পর্যন্ত আবিরের ফাঁসি কার্যকর না হবে, ততদিন তাদের মন শান্ত হবে না। আসামির যাতে ফাঁসি হয়, সে জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন। সোহেল রানা জানান, তার মেয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনায় আজ দোয়া করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে খাবার খাওয়ানো হয়েছে।
সোহেল আরও বলেন, আমরা দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আমি বড়। ছোট ভাই এখনও বিয়ে করেনি। বোনের কোনো সন্তান নেই। যার কারণে আয়াতই আমাদের পরিবারের সবার আদরের। আয়াত আমার কাছে যা আবদার করত, তার বেশি আবদার ছিল দাদার কাছে। আবার টেলিফোনে নানার কাছেও অবদার করত চকলেট, খেলনাসহ নানা জিনিস পাঠানোর জন্য।
আলিনার মা তামান্না ইসলাম বলেন, বুঝতে শেখার পর থেকেই আয়াত তার জন্মদিনের আগে বিভিন্ন ধরনের বায়না ধরত। এ বছরও তার বায়না ছিল জন্মদিন পালনের। সেজন্য আমার বাবাকে বলেছিল কেকের টাকা পাঠাতে। কয়েক মাস আগে তার বাবা একটা সাদা জামা কিনেছিল। কিন্তু সেটা সে পরেনি, জন্মদিনে পরবে বলে। আয়াতকে জামাটা পরতে বলায় সে বলেছিল পরলে পুরানো হয়ে যাবে। জন্মদিনে ওই জামা পরে সে কেক কাটবে। কিছুই আর হলো না। তিনি বলেন, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন। ভাবতেন, একদিন না একদিন মেয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু এখন তো আর সান্ত্বনার ভাষাও নেই। কাঁদতে কাঁদতে এমন অবস্থা হয়েছে, এখন আর চোখে পানি আসে না। তামান্না বলেন, মেয়ের জন্মদিনে তিনি জামা কিনে দিতেন। চকলেট, খেলনাসহ নানা উপহার দিতেন। কেক কাটতেন। চারদিকে তাকালে আজ শুধুই হাহাকার। তামান্না বলেন, আমার বাবা ওমান প্রবাসী। আয়াতের ৯ মাস বয়সে উনি চলে যান। কিন্তু প্রায় সময় মোবাইলে নাতনীর সাথে কথা বলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে নানাকে বলেছিল চকলেট পাঠাতে আর কেক কিনে দিতে।
আলিনার দাদা মনজুর হোসেন বলেন, তার নাতনিকে সবাই স্নেহ করতেন। এ কারণে তার জন্মদিনে আশপাশের সবাই উপস্থিত থাকতেন। আলিনা সবার মুখে কেক তুলে দিত। এবার কে কেক খাইয়ে দেবে? আলিনা না থাকায় পুরো পরিবার শোকে ডুবে আছে। তার ফুটফুটে মুখটি সবার চোখে ভাসে। হত্যাকারীর ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের কারও মনে শান্তি নেই।
গত বছর আয়াতের চতুর্থ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শোয়েব, ফারাহ আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, মাইশা আক্তার, মুনমুন আক্তারসহ ১০ থেকে ১৫ জন শিশু-কিশোর অংশ নিয়েছিল। তাদের কেউ আলিনার প্রতিবেশী, কেউ আত্মীয়। সুমাইয়া আজাদীকে বলে, আয়াতের জন্মদিনে অনেক মজা হতো। তাকে যে মেরেছে, আমি তার শাস্তি চাই।
বাড়ির পাশে মক্তবে পড়তে যাওয়ার সময় গত ১৫ নভেম্বর নিখোঁজ হয় আয়াত। ২৫ নভেম্বর নিখোঁজের ১০ দিন পর বাসার ভাড়াটে আবির মিয়াকে পিবিআই আটক করে। আটকের পর আবির আয়াতকে হত্যার কথা স্বীকার করে। পুলিশ বলছে, ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণ করেছিল সে। অপহরণের পর শিশুটি চিৎকার করলে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। পরে তার লাশ ছয় টুকরো করে ফেলে দেয় আবির। এর মধ্যে আলিনার দুটি পা ও মাথা উদ্ধার করেছে পিবিআই। নিখোঁজ হওয়ার পর ১০ দিন পর্যন্ত পরিবার জানত না যে আয়াত হত্যার শিকার হয়েছে।