জন্ম তো সবাই দেয়, কিন্তু সবাই বাবা নয়। বাবা তো সেই, যে সন্তানকে শুধু জন্ম দেন না, শুধু পৃথিবীর আলো দেখান না, শুধু জীবন দান করেন না বরং জীবনে আলো দান করেন। তিনি শুধু সন্তানকে অন্ন–বস্তু দিয়ে ক্ষান্ত হন না, তিনি সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করেন।
পৃথিবীতে আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বহু পিতা দেখি, যারা সন্তানের জন্ম দেয় দামি হাসপাতালে, শিক্ষা দেন নামি স্কুলে, রাখেন বিলাসবহুল বাড়িতে, খাবার খাওয়ান স্বাস্থ্যসম্মত, পোশাক পরান রুচিসম্মত দামি ব্র্যান্ডের, দেন দামী ফোন ইত্যাদি। কিন্তু দামি মানসিকতা তৈরি করতে অক্ষম প্রায় অনেক পিতা। তারা সন্তানদের বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে চালাতেই বেশি পছন্দ করে। তারা ভাবে, তাদের তো অনেক অর্থ সম্পদ, এতোটুকু তো তাদের সন্তানরা ভোগ করতেই পারে। তারা সন্তানদের প্রাচুর্যে ভাসিয়ে দিয়ে একবারও ভাবেন না সন্তান কেমন আছে? অর্থাৎ সে সামাজিকভাবে ও মানসিকভাবে কেমন আছে? সে কি সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠছে নাকি অতিরিক্ত প্রাচুর্য ও আদরে সে নীতি–নৈতিকতাকে পেছনে ফেলে বিকৃত মানসিকতা নিয়ে সমাজকে অসুস্থ করে তুলছে।
আমার মনে হয় এই সমস্ত পিতা যারা সন্তানদের অতিরিক্ত আদর ও ভালোবাসার নামে সন্তানদের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছেন তারা সন্তানদের স্নেহের এতই অন্ধ যে তারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ দেখতে পান না।
অপরদিকে যে সকল পিতা তাদের সন্তানদের বলার মত তেমন কোনো সুযোগ–সুবিধা দিতে পারেন না, পারে না দিতে দামি খাবার বা পোশাক কিংবা গাড়ি বা বাড়ি, দেখা যায় তারাই হয় মানুষের মত মানুষ। অর্থাৎ মানবীয় গুণের অধিকারী, নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, সমাজের আলো।
আমাদের সন্তানরা যদি ভালো–মন্দ, ন্যায়– অন্যায়, উচিত অনু উচিত শিক্ষা না পায় তবে সে কীভাবে সমাজ গঠন করবে? আমাদের সুবিধাভোগী সন্তানরা যদি সুবিধা বঞ্চিত সন্তানদের কাতারে না দাঁড়ায় তাহলে সমাজে সমতা তৈরি হবে না। আর এটা করতে হবে একমাত্র পরিবার থেকেই।
আমি এখানে পিতার কথা উচ্চারণ করছি এই কারণে, আমি আজকাল বহু পরিবার দেখেছি যেখানে বাবারা চায় তাদের সন্তান থাকুক দুধে ভাতে। ক্ষমতার দৌড়াত্বে মায়েরা সেখানে একেবারেই অসহায়।
আজ সমাজের যেই দশা আমরা ভালো আছি জোর দিয়ে বলতে পারি না, এটা অপ্রিয় সত্য। আমাদের সবাইকেই চেষ্টা করতে হবে আমাদের সন্তানদের শুধু দুধে ভাতে নয়, সামাজিক ও মানসিকভাবেওভালো রাখতে। এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে সবকিছু। এখন সন্তান পালনের দায়িত্ব শুধু মায়ের উপর বর্তায় না, সমান অধিকারের যুগে বাবাকেও নিতে হবে কিছু দায়িত্ব। শুধু সন্তানের দুধ ভাতের চিন্তা না করে আমার মনে হয় বাবাদেরও মায়েদের সাথে কিছু দায়িত্ব নিতে হবে যাতে আমাদের বংশধরেরা নিরাপদ, সুস্থ ও মানবিক গুণসম্পন্ন হয়। এর জন্য আমার মনে হয় প্রথমে বাবাদের যা করতে হবে তা হলো সন্তানের সামনে মাকে সম্মান করা। কারণ যে সন্তান তার মাকে সম্মানিত হতে দেখবে, সে অন্যকেও সম্মান দিতে শিখবে, এটা আমার বিশ্বাস।
যে বাবা সন্তানের সামনে তার মাকে অসম্মান করবে সে সন্তানও তার মাকে অসম্মান করবে। পরবর্তীতে মা সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিতে চাইলেও সন্তান সে শিক্ষা নিবে না কারণ আমরা মানুষরা সব সময় খারাপ টাই গ্রহণ করি। বাবা মার সম্পর্কের সুযোগ সন্তানরা নেয় এবং ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে বাবার মত। হয় মানুষকে সম্মান করে না হয় সে হয় খুনি, ধর্ষণকারী কিংবা লিপ্ত হয় সমাজবিরোধী কোনো কাজে। বাস্তবতা কিন্তু তাই, আমরা কেউ তা অস্বীকার করতে পারবো না।
একটা সুস্থ পরিবারই একটা সুস্থ সমাজের জন্ম দেয়। যেমন একটা জাহাজ নিরাপদে তীরে পৌঁছে কেবলমাত্র একজন দক্ষ ক্যাপ্টেনের কারণে ঠিক একটি পরিবারও সুন্দরভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় একজন বিচক্ষণ স্বামী বা বাবার কারণে।
তাই আসুন আমরা আমাদের স্বার্থে, আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে একজন আদর্শ পিতা হয়ে উঠি।
জন্ম তো সবাই দেয়, সেই হোক মানুষ কিংবা জন্তু জানোয়ার। পিতা হয় শুধু মানব সন্তান। কেবলমাত্র মানুষের সন্তানকে জন্মের পর গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শিখতে হয় অন্যরা জন্মের পরপরই নিজ পায়ে ভর করে হাঁটতে পারে। তাই আসুন আমরা সবাই জন্মদাতা নয় পিতা হয়ে উঠি।