আমাদের দেশে জীবনদায়ী ওষুধের যত্রতত্র ব্যবহার, নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে এখন জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। মানুষ আশংকা করছে তাদের ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা কতটুকু তা নিয়ে। আমাদের দেশে ওষুধ বিক্রি করার কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে ওষুধ দোকানদারও তার ইচ্ছামতো ওষুধ বিক্রি করে থাকে বেশি লাভের আশায়। ওষুধে রোগীর ভালো কি মন্দ হবে সেটা তার দেখার বিষয় নয়। জানারও কথা নয়। তার চাহিদা মতো লাভ হলেই হলো। সরকারি কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে আমাদের দেশে যেকোনো লোক ওষুধ ব্যবসা করতে পারে। যাদের কোনো ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই, কয়েক দিন কোনো ওষুধের দোকানে থাকলেই সে মনে করে ডাক্তার হয়ে গেছে। তারপর বেশি লাভের আশায় নিজে ডাক্তার সেজে ওষুধের দোকান খুলে বসে।
দৈনিক আজাদীতে গত ২৫ মার্চ ‘নকল–ভেজালের ভিড়ে আসল চেনা দায়, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নকল–ভেজাল–মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যসামগ্রীতে ছেয়ে গেছে দেশ। ‘নকল হইতে সাবধান’ এই বিজ্ঞাপন এতটাই প্রচলিত যে, কেউ আর ‘সাবধান বাণী’ হিসেবে এ কথাটি মানতে চায় না। শিক্ষিত–অশিক্ষিত সকলের জন্যই সমান প্রযোজ্য। ভেজালের এ সাম্রাজ্যে সবই আছে, শুধু ‘আসলটাই’ উধাও। ভেজাল খাবার খেয়ে আমরা জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি, নতুন প্রজন্মকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। কখনো ভিন্ন ভিন্ন আবার কখনো একত্রে খাদ্যে ভেজাল রোধে অভিযান চালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ পুলিশ। তবে অভিযোগ রয়েছে, ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্যের তুলনায় অভিযান যথেষ্ট অপ্রতুল।
ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহর–বন্দর–জনপদ। খোলাবাজার, হোটেল–রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড থেকে শুরু করে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, কনফেকশনারি, ক্যান্টিন, এমনকি মুদি দোকান পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে নকলের। কোথায় নেই ভেজাল? হাত বাড়িয়ে যা কিছু খাচ্ছি সবকিছুতেই ভেজাল। বাজারে এমন কিছু নেই, যা নকল কিংবা ভেজাল হচ্ছে না। পণ্য ভেরিফিকেশনের জন্য হলোগ্রাম, স্টিকার, স্ক্যানার, আরএফআইডি ট্যাগ, বারকোড ইত্যাদি সিস্টেম চালু আছে। কিন্তু সেসব হলোগ্রাম বা স্টিকারগুলোও যখন নকল করা হয় তখন গ্রাহক কোনোভাবেই আর আসল–নকল আলাদা করতে পারেন না। নকলের ভিড়ে আসল চেনা দায়। দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে ভেজালের গণ্ডি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষিত বা ভেজালমিশ্রিত খাদ্য মানুষের জন্য স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে থাকে। ভেজাল একটি নেতিবাচক শব্দ। যার অর্থ মিশ্রিত, মেকি বা খাঁটি নয় এমন। উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণকে ভেজাল বলে। অন্য কথায় খাদ্যের পরিমাণ, স্থায়িত্ব অথবা স্বাদ বৃদ্ধির জন্য কাঁচা বা প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্রীতে এক বা একাধিক ভিন্ন পদার্থ সংযোজন করাকে বোঝায় ভেজাল। খাবারে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ, আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু তারপরও দেখা যায়, দেশে বিশুদ্ধ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো বাংলাদেশের জন্য একটি প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে আজাদীতে। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাবে দেশে মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে বাজার সয়লাব হয়েছে। অনেকে আবার বিএসটিআইর লোগো ছাপিয়ে এসব মানহীন পণ্য বাজারজাত করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটা থেকে রেহাই মিলবে না। তিনি বলেন, এখন মাঝে মাঝে অভিযান হয়, জরিমানা করা হয়। কার্যত কোনো সুফল আসছে না। এভাবে চলতে থাকলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথেচ্ছভাবে উচ্চমাত্রার ওষুধ ব্যবহারের ফলে অনেক সময় তা কার্যকারিতা হারায়। আর অপ্রয়োজনে উচ্চমাত্রার ওষুধ সেবনে মানবদেহে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তা কিডনি, লিভার ও হৃৎপিণ্ডের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। দেখা দিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ। তাঁরা বলেন, খাদ্যে ভেজাল রোধে নিরাপদ খাদ্য আইনের সঠিক প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা পরিহার করাও আবশ্যক। দেশে ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে প্রভাবশালী কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। সেই সঙ্গে প্রয়োজন জনগণ কর্তৃক সচেতন ও সোচ্চার হওয়া। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।