ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, এটি জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, মশার প্রজননস্থল, মৌসুমি ও জলবায়ুগত প্রভাব, নগরের অবকাঠামো এবং মানুষের আচরণ, এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করলে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে না।
গতকাল রোববার নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভাইরাসের জিনোমের স্বরূপ উন্মোচন’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এআরএফ) উদ্যোগে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
শাহাদাত বলেন, চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর হার অনেকটা নেই বললেই চলে। কিন্তু এই রোগে সবচেয়ে বেশি সাফার করে। চিকুনগুনিয়ার সাথে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অনেকটা মিলে যায়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগের লক্ষণে দেখি, জয়েন্টে জয়েন্টে পেইন এবং সাথে সকালে ঘুম থেকে উঠলে জয়েন্টগুলো অসম্ভব শক্ত হয়ে যাওয়া। এগুলোর সাথে কিন্তু চিকুনগুনিয়ার মিল পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, আল্টিমেটলি চিকুনগুনিয়ার রোগীগুলোর কিন্তু পুরো বছরেই কোনো না কোনোভাবে এই জয়েন্টে ব্যথাগুলো থেকে যায়। সুস্থ হওয়ার পরেও এই জয়েন্টে ব্যথা থেকে যায়। অনেক মাস ধরে এই ব্যথার দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদেরকে মূল জায়গায় ফোকাস করতে হবে। আমাদেরকে পাবলিক এওয়ারনেসের জায়গায় আসতে হবে।
মেয়র ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণসহ নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চসিকের স্বাস্থ্যবিভাগের উন্নয়নসহ অন্যান্য নাগরিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থের প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, সবকিছু নির্ভর করছে অর্থের ওপর। আমি যতই পরিকল্পনা করি না কেন, সেটা বাস্তবায়নে দিন শেষে আমার টাকা লাগবে। যদি এখন এই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য আরো বেশি গবেষণা করতে চাই, গবেষকদের টাকা দিতে হবে। যেমন মশক নিধনে লার্ভিসাইড হিসেবে বিটিআই ব্যবহার করছি। যেটা অনেক ব্যয়বহুল।
ডা. শাহাদাত বলেন, সবকিছুর ক্ষেত্রে মানি ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট ফ্যাক্টর। আপনারা জানেন, অন্তর্বর্তী সরকার শহর পরিষ্কার করার মেশিন কেনার জন্য সামান্য ৩০০ কোটি দিতে পারেনি। কাজেই হোল্ডিং ট্যাঙ দিয়ে আমার শহরের মানুষগুলোকে তাদের দৈনন্দিন সেবা দিতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বন্দর অনর্থক টাকা নষ্ট করে। তারা এমন এমন ব্যাংকে গত ১৬ বছর টাকা রেখেছে সেগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কত টাকা। অথচ ন্যায্য হোল্ডিং ট্যাঙ দিতে তাদের অনেক কষ্ট হয়ে যায়। আমি মনে করি, দায়িত্ব থাকলে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ শহরকে ভালোবাসতে হবে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর সঠিকভাবে আমাদের দিতে হবে। আবাসিক গৃহকরে আমি কোনো চাপ দিচ্ছি না। আমি মনে করি, দিন শেষে তারা কষ্টে থাকে। কিন্তু বাণিজ্যিক করে কাউকে আমি ছাড় দেব না। এটার ওপরে শহরের উন্নয়ন নির্ভর করছে।
তিনি বলেন, বন্দরের ৩০–৪০ টনের ভারী গাড়ি চলে আমার ১০ টন ধারণক্ষমতার সড়কের ওপর দিয়ে। অতিরিক্ত ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়। ১ কোটি ৯৭ লাখ বর্গফুটের কর ২৬৪ কোটি টাকা দেবে আমাকে। আ জ ম নাছিরের সময় ৪৫ কোটি টাকা দিত। তারা প্রতিবাদ করেনি। কারণ তারা বিজনেস করত বন্দরে। আমি বিজনেস করি না বন্দরে। আমি চসিককে স্বাবলম্বী করতে চাই। মানুষের যে অধিকার সড়ক, বাতি, ময়লা পরিষ্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলোর পেছনে ব্যয় করতে চাই।
মেয়র বলেন, এখন আমি আছি। আমার নেঙট জেনারেশন বাস করবে। এ শহরকে আমাদেরই সুন্দর করে রাখতে হবে। এ শহরটা শুধু মেয়র ডা. শাহাদাতের একার শহর নয়। এটা সবার শহর। এ ধরনের শহরপ্রেম ও দেশপ্রেম যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ আপনি সাসটেইনেবল সিটি গড়ে তুলতে পারবেন না। এটার জন্য আমি শুরু করেছি স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম। ছোট ছোট বাচ্চারা যাতে ছোটকাল থেকে শিখে ময়লা কীভাবে ফেলতে হয়, ময়লা কোথায় ফেলতে হয়, ময়লা বাইরে ফেললে কী সমস্যা হয়।
তিনি বলেন, সাসটেইনেবল সিটি তৈরি করার জন্য মূল জায়গা হচ্ছে শহর সুন্দর রাখা। এ শহরকে যতক্ষণ ক্লিন রাখতে না পারব, এ দায়বদ্ধতা যতক্ষণ আমার মধ্যে না আসবে এ শহরটা আমার, এ শহরে আমার বাপ–দাদারা ছিলেন। গবেষণা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলেন, এই গবেষণা চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মোকাবিলায় এখন আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম বাকি মাসুদ বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন কেবল চিকিৎসা–সংক্রান্ত সমস্যা নয়; এটি একটি সমন্বিত জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ। গবেষণাভিত্তিক তথ্য ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। এসপেরিয়া সবসময় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও জনস্বার্থে কার্যকর উদ্যোগের পাশে রয়েছে।
রিসার্চ প্রজেক্টের টিম লিডার অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান বলেন, ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণে আমরা একাধিক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন শনাক্ত করেছি, যা এই অঞ্চলে রোগের বিস্তার ও তীব্রতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব তথ্য ভবিষ্যতে চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।












