জনসভা-পথসভার উন্মুক্ত প্রান্তরগুলো

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

কুমার প্রীতীশ বল | মঙ্গলবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

শঙ্খ ঘোষের ‘বাবু মশাই’ কবিতাটা খুব মনে পড়ছে। ‘কলকাতা’র স্থানে ‘চট্টগ্রাম’ বসিয়ে দিলে মিলে যাচ্ছে আদ্যপান্ত–‘সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে ‘চট্টগ্রাম’!/বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা?/ আর তাছাড়া ভাই/ আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে/ নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে/ যাবে খোলনলিচা…/ শুনুন যাঁরা মস্ত পরিত্রাতা/ এ ‘চট্টগ্রামের’ মধ্যে আছে আরেকটা ‘চট্টগ্রাম’/ হেঁটে দেখতে শিখুন।’ চট্টগ্রাম আমাদের বাপদাদার আমলেই হয়ে গেছে বীর চট্টগ্রাম। সুকান্ত চট্টগ্রামে এসেছিলেন ১৯৪৩ সালে। গিয়েছিলেন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে লিখেছিলেন চট্টগ্রাম ১৯৪৩–‘ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম চট্টগ্রাম: বীর চট্টগ্রাম। আমার ‘স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম’ ‘বীর চট্টগ্রাম’ হয়ে উঠার নেপথ্যে আছে অনেক জনসভাপথসভাআন্দোলনসংগ্রাম। এসব সংঘটিত হয়েছিল চট্টগ্রামের নানান ময়দানে, সড়কমহাসড়ক, মোড়, বাজার, টার্মিনাল, চত্বরে। এককথায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। নব্বইয়ের দশকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিয়েছিল। সেসময় আজব এক কারবার দেখলাম। সভাসমাবেশ করতে হবে ঘরের মধ্যে। মুসলিম হল, জে.এম.সেন হল, ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে সভা করতে হবে। মূল আয়োজন ঘরের মধ্যে কিন্তু মিলনায়তন পূর্ণ হয়ে চারপাশ লোকে লোকারণ্য।

কুড়ি শতকের প্রারম্ভে বাংলায় শুরু হয় ‘স্বদেশী আন্দোলন’। ১৯০৫ ও ১৯০৬ সালে রাউজানের খেলারঘাটের কাছাকাছি গৌরাঙ্গ রুদ্রের বাজার সংলগ্ন মাঠে (বর্তমানে যেস্থানে উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত) পরপর দু’বছর ‘চট্টগ্রাম সম্মিলনী’র বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ সালের সম্মেলনে সরকার ১৪৪ধারা জারি করে। প্রতিবছরের মতো সেবছরও মেলা, শিল্প প্রদর্শনী, খেলাধুলার আয়োজন হয়। সম্মেলনে আগতদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মেলার পণ্যসামগ্রির ক্ষয়ক্ষতি করে। এসম্মেলনে কোলকাতা থেকে বিপিন পাল, কুমিল্লা থেকে অখিল দত্ত, চট্টগ্রামের যাত্রামোহন সেন, শাহ বদিয়ুল আলম, কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন বন্ধ করে দেওয়ায় চট্টগ্রামবাসীর মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এবছর চট্টগ্রাম আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিতাই সেন লিখেছেন,‘চট্টগ্রামে তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুবই উজ্জ্বল ছিলো। তাই স্থানীয় পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের আগমন সংবাদ প্রচারিত হলে হিন্দুমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিলো। যামিনীকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়ির সামনে ছিলো বিশাল প্রাঙ্গণ যেখানে প্রায় পনেরো হাজার লোক সম্মিলিত হতে পারত। এখানে কবিকে দেখার জন্য সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। রবীন্দ্রনাথ ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জনতাকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানান।’ পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছেন, ‘ঐ বাড়ির সম্মুখস্থ মাঠে রবীন্দ্রনাথকে দেখার জন্য বহু মানুষের জনসমাগম হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় ঐ সময়েই রচিত একটি গান পরিবেশন করেন।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চট্টগ্রামে আসার ফলে এই জেলার স্বদেশী আন্দোলনে নতুন এক উদ্দীপনা জাগে।’

১৯০৯ সালে ২৫ এপ্রিল তারিখে বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার লালদীঘির মাঠে বলীখেলার আয়োজন করেন। পরবর্তীকালে তা ‘জব্বারের বলীখেলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চট্টগ্রামের যুব সমাজকে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি বলীখেলার সূচনা করেন। সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্রীড়াও যে লড়াইসংগ্রামের অংশ, তা আবদুল জব্বার বাঙালির বোধের মধ্যে আনেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। এউপলক্ষে বর্তমান আন্দরকিল্লাস্থ রেডক্রিসেন্ট মেটারনিটি হাসপাতাল ও কোহিনূর প্রিন্ট্রার্স সম্মুখস্থ মাঠে (এখন সে মাঠ নেই। এমাঠে চট্টগ্রামবাসীকে রবীন্দ্রনাথ গান শুনিয়ে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন) এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের অপরপ্রান্তে ছিল জেনারেল হাসপাতাল। দেশবন্ধু’র জনসভাটি ছিল চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম বৃহত্তম জনসভা। সর্বস্তরের জনতা এসভায় উপস্থিত হয়েছিল। জমায়েত মাঠ পেরিয়ে হাসপাতালের পাশের পাহাড়, মিউনিসিপ্যাল অফিসের সামনের রাস্তা পর্যন্ত কানায়কানায় পূর্ণ হয়েছিল। এসভায় উপস্থিত ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন, গিরিজাশঙ্কর চৌধুরী, অম্বিকা চক্রবর্তী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন, শেখচাটগাম কাজেম আলী প্রমুখ। সেদিন চট্টগ্রামের অনেক উকিলডাক্তারমোক্তারব্যবসায়ী দেশবন্ধুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের উপাধ্যক্ষ নৃপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ৭৫০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে খদ্দ্‌র পড়ে আন্দোলনে যোগ দেন। চট্টগ্রাম কলেজের দপ্তরী সারদা দে আন্দোলনে যোগ দিতে আসলে দেশবন্ধু বুকে জড়িয়ে ধরেন। দৈনিক আজাদী লিখেছে, সভায় মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, মৌলানা শওকত আলী, মৌলানা আকরাম খাঁ, . সাইফুদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এরপর মাঠের নাম গান্ধী ময়দান হয়ে যায়।

প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের ছাত্রান্দোলন ও ছাত্রসভার সূত্রপাতের কথাও উল্লেখ দরকার। পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছেন, ‘পানোন্মত্ত গুর্খা সিপাহী পাথরঘাটার দিকে কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর (তখন ছিল বর্তমান মুসলিম হাইস্কুল যেখানে অবস্থিত সেই বাড়ীতে) ছাত্র পুলিন চক্রবর্তীকে বেত দিয়ে আঘাত করে। বৃটিশ সরকারের সেই গুর্খা সৈনিকেরা ঐ ছাত্রকে আঘাত করার প্রতিবাদে শহরের সব স্কুলকলেজের ছাত্ররা পরদিন বিকালেই জে.এম. সেন হল প্রাঙ্গণে এক সভা করে। চট্টগ্রামে কেবল ছাত্রদের উদ্যোগে সম্ভবত এটাই প্রথম ছাত্রসভা।’ গান্ধী ময়দানে ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলন। এরপর গান্ধী ময়দানের নাম বদলে ‘মুসলিম হল মাঠ’ হয়ে যায়।

পলোগ্রাউন্ড মাঠে যুক্তবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা’র ১৯৩৬ সালের জনসভাটি গণজাগরণের জন্য বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে পাথরঘাটা বালিকা বিদ্যালয় মাঠে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ যোগদান করে। চট্টগ্রামের অনেক মুসলিমলীগ নেতা এসভায় উপস্থিত ছিলেন। নেতাজী বন্ধীমুক্ত আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন দল ও মতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আন্দোলনের চাপে সরকার পরবর্তীকালে সাজাপ্রাপ্ত অনেক রাজবন্ধীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বামপন্থীরা জে.এম. সেন হল প্রাঙ্গণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে ‘না এক পাইনা এক ভাই’ ধ্বনি তুলে প্রতিবাদ সভাবেশের আয়োজন করে। এসভায় যোগ দিতে কুমিল্লার মৌলভী আসরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, শ্রীত্রৈলোক্য চক্রবর্তী এসেছিলেন। সভা শুরুর মুহূর্তে পুলিশ এসে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা করে সভাস্থল খালির নির্দেশ দেয়। আয়োজনকারীরা নির্দেশ অমান্য করে সভা শুরু করলে পুলিশ মৌলভী আসরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, শ্রীত্রৈলোক্য চক্রবর্তী ও সভার সভাপতি সুধাংশু বিমল দত্তকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারারাত বিক্ষোভ চলে। পরদিন ছিল পূর্ণদিবস হরতাল।

১৯৪৫ সালের শেষের দিকে বৃটিশ সৈন্যরা এক মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম জেলা নারী সমিতির নেত্রী কল্পনা দত্তের নেতৃত্বে মুসলিম হল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের বৃহত্তম জনসভাটি মুসলিম হল মাঠে ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ।

চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ময়দান লালদিঘির মাঠে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬দফা ঘোষণা করেন। এরপর এটি ঐতিহাসিক লালদিঘীর মাঠ হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মনি সিং প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন। ১৯৭০ সালে পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জনসভাটি বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাসে অনিবার্য অংশ গেছে।

একাত্তরের ১৫মার্চ ‘শিল্পীসাহিত্যসংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’এর অনুষ্ঠানের দিন লালদিঘীর মাঠ ছিল লোকে লোকারণ্য। গণসংগীত পরিবেশনার পর অধ্যাপক মমতাজউদ্দিনের লেখা ‘এবারের সংগ্রাম’ পথনাটক পরিবেশিত হয়। তিনি ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামে আরেকটি পথনাটক লেখেন। প্যারেড মাঠে একাত্তরের ২৪মার্চ পথনাটকটি দেখার জন্য ৮০হাজার দর্শক হয়েছিল। নাটক চলাকালীন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহের সোবাহান জানালেন, বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাধা দিচ্ছে জনসাধারণ। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি চালাচ্ছে। খবরটি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা দলে দলে ছুটে গেল বন্দরে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ বন্দরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। সাগরিকা সিনেমা হলের সামনে, এয়াকুব আলী এন্ড সন্সের সামনে আর্মিরা গুলি চালায়। ওখানেও হতাহত হয়। সেদিন ৪০জন বাঙালি শহিদ হন।

শহর চট্টগ্রামের আরও অনেক ময়দান, সড়কমহাসড়ক, মোড়, চত্বরে জনসভাপথসভা হতে দেখেছি। এরমধ্যে বিশেষভাবে স্মরণে আছেজাম্বুরি মাঠ, নিউমার্কেট মোড়, অলংকার মোড়, রেয়াজুদ্দিন বাজার আমতলা, দোস্তবিল্ডিং চত্ত্বর, লালদিঘীর মোড়, কদমতলির মোড়, আন্দরকিল্লার মোড়, রেলওয়ে স্টেশন, দেওয়ানহাট, বাদামতলি, বারেকবিল্ডিং, বিআরটিসি, বন্দরটিলা, সল্টগোলা রেল ক্রসিং, স্টিল মিল, বহদ্দার হাট, মুরাদপুর, জিইসি মোড়, প্রেসক্লাবের সামনে ইত্যাদি। দোস্তবিল্ডিং চত্বর ও লালদিঘীর মোড়ে জনসভাপথসভার জন্য পরিচিত করতে আওয়ামীলীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।

তথ্যসূত্র : পূর্ণেন্দু দস্তিদার: স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম; নিতাই সেন: চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও অন্নদাশংকর; হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা; আবদুল হালিম দোভাষ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধনদী জীবিত সত্তা : নদী বাঁচান, দেশ বাঁচান
পরবর্তী নিবন্ধ‘জীবনে আনন্দ নিয়ে বাঁচো’