গত শুক্রবার সকাল ১০.৩৮ মিনিটে ঢাকার অদূরে নরসিংদীর মাধবদীতে সংঘটিত ভূমিকম্পটি রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৭ ও মার্কিন ভূতত্ত্ব কেন্দ্রের তথ্যে ৫.৫। এটি হয়েছে ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে, আর স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাধবদীর ভূমিকম্পটি বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হবে সেটির মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা আবহাওয়া অধিদপ্তর ৫.৭ মাত্রার কথা জানালেও মনে হচ্ছে এটির মাত্রা আরও বেশি হবে। কারণ, আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে তাই মনে হয়। নারায়ণগঞ্জের আশপাশে কয়েক বছরে আরও ছোট ছোট কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে।
তাঁরা বলেন, যে মাত্রায় ভূমিকম্প হয়েছে এবং যেভাবে ঝাঁকুনি হয়েছে, সে তুলনায় আল্লাহর রহমতে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। তবে অনেক ভবন দেবে গেছে। ঢাকা শহর এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে অধিকাংশ এলাকায় কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। যেগুলো ছিল, সেগুলোকে কনভার্ট (রূপান্তর) করে ফেলা হয়েছে। ঢাকা শহরে ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্যোগে মানুষ যে খোলা জায়গায় দাঁড়াবে, সে সুযোগ নেই। ঢাকায় শত শত খোলা জায়গা তৈরি করা দরকার ছিল, কিন্তু রাষ্ট্রের উদ্যোগ না থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে কখনোই এটা করা হবে না। এই উদাসীনতা দুর্যোগের সময় ঢাকাবাসীর জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। খেলার মাঠগুলোকে শুধু খেলাধুলা নয়, দুর্যোগেও আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নগর–পরিকল্পনার প্রাথমিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিককে ৫০০ থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে একটি খোলা জায়গা, গ্রিন স্পেস বা পার্কের সুবিধা দিতে হবে। ঢাকার মতো জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় এই দূরত্ব অবশ্যই ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকার কথা। শহরগুলোয় ২০ থেকে ২৫ ভাগ গ্রিন স্পেস (সবুজ জায়গা) থাকা আবশ্যক। অথচ ঢাকায় এই গ্রিন স্পেসের পরিমাণ কমে ৫ শতাংশ বা তার নিচে নেমে এসেছে। পৃথিবীর সব শহরে এসব মৌলিক বিষয় অনুসরণ করা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরের সমপ্রসারণে এসব ভাবনা নিয়ে রাষ্ট্র কাজ করছে না। খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ তৈরি করা ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিয়ে পরিকল্পনার মধ্যে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, কারণ, ভবন ভেঙে পড়লে সেই ধ্বংসাবশেষ সরাতে রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি শৈথিল্য দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সামপ্রতিক ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এ–ও বলা হয়েছে যে এ ধরনের খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার ব্যাপক সংকট রয়েছে। সংখ্যাগুলো দেওয়া থাকলেও এগুলো তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
উচ্চতার সঙ্গে কম্পন অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে। বহুতল ভবনে (যেমন ছয়তলা বা বারোতলা) কম্পনের প্রভাব বেশি হয় এবং এটি বেশি সুইং (দুলতে) করে। অন্যদিকে, গ্রাউন্ড ফ্লোর বা নিচের তলায় (যেমন দুইতলায়) ধসে যাওয়ার একটি ঝুঁকি থাকে।
তাঁদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প পাওয়া যায় না। আমাদের ভূ–খণ্ডে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ ও মানিকগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পই তথ্যসম্পন্ন। তবে দেড়শ বছর আগে গাইবান্ধার দুবড়িতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ১৬৬৪ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে যমুনা হয়ে গেছে বলা হলেও এটি নিয়ে দ্বিমত আছে। ১৭৬২ সালে আরাকানে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এটিতে চট্টগ্রামে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তাই গত ৪–৫ শত বছরের ভূমিকম্পে বাংলাদেশে তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৮৯৭ সালের শিলংয়ের ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেটে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঢাকায় কিছু বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না এবং কেউ যেন আতঙ্কিত না হয়। ভূমিকম্পের সময় প্রত্যেককে ভবনের মধ্যেই থাকতে হবে। ভূমিকম্পের সময় বের হওয়া যাবে না। কেননা ভূমিকম্প হয় ১০–৩০ সেকেন্ড। মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে প্রচার চালিয়ে জনমানুষের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।







