জনভোগান্তি এখনো কমেনি

অনলাইন জন্মনিবন্ধন প্রযুক্তির বিড়ম্বনাসহ নানা সমস্যা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

অনলাইন জন্মনিবন্ধনে মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানাভাবে চেষ্টা করেও জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না অনেক মানুষ। শহর ও গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ধর্না দিচ্ছেন। কিন্তু দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, সার্ভার ডাউনসহ প্রযুক্তির বিড়ম্বনায় দিনের পর দিন ধর্না দিয়েও মিলছে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন্মনিবন্ধন সনদপত্র।
আবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন করার আগে পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধন তৈরি করেছে নতুন সংকট। একজন শিশু বা কিশোরের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে তিনটি জন্মনিবন্ধন সনদপত্র তৈরি করতে হচ্ছে। একটি কম্পিউটার এবং একজন অপারেটরকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চাপ সামলাতে হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন ছাড়া ন্যাশনাল আইডি কার্ড করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে টিকা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। অপরদিকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদে জন্মনিবন্ধনকালে সামান্য ভুল হলেও তা ঠিক করতে ছুটতে হচ্ছে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সবকিছু মিলে জন্মনিবন্ধন নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ।
জানা যায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে সনদপত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অনলাইনে নিবন্ধন শুরু করার আগে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে কয়েক কোটি নাগরিককে জন্মনিবন্ধন সনদপত্র দেওয়া হয়েছিল। ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেওয়া ওইসব সনদ তখন আপডেট করা হয়নি। এখন ওইসব সনদ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এতে করে কয়েক কোটি ম্যানুয়েল জন্মনিবন্ধন সনদপত্র বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে নতুন করে দেশের সব নাগরিককে অনলাইন জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে। কিন্তু সার্ভার সমস্যাসহ নানা সমস্যার কারণে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি জনভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় এবং ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে একজন ডাটা অপারেটর একটি কম্পিউটার নিয়ে অনলাইন জন্মনিবন্ধনের কাজ করছেন। দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন থেকে রেকর্ডকৃত ডাটা সার্ভারে লোড করতে পারেন না। কয়েক লাখ মানুষের একেকটি ইউনিয়ন পরিষদে কিংবা ওয়ার্ডে একটি মাত্র কম্পিউটার দিয়ে কাজ সারতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। সার্ভার সমস্যার কারণে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে মানুষের ভিড় লেগে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারনেট এবং সার্ভার ঠিক থাকলে একটি জন্মনিবন্ধন রেকর্ড করতে ত্রিশ মিনিট লাগে। একজন অপারেটর সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ত্রিশ-চল্লিশটির বেশি রেকর্ড করতে পারেন না। অথচ প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও কাউন্সিলর অফিসে শত শত মানুষ সকাল থেকে লাইন ধরেন। আবার সার্ভার ডাউনসহ নেটের সমস্যার কারণে ডাটা অপারেটর দিনভর চেষ্টা করেও অনেক সময় একটিও জন্মনিবন্ধন রেকর্ড করতে পারেন না।
এদিকে ২০০১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে অনেকের অবস্থা নাজুক। এসব ক্ষেত্রে প্রথমে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন সনদ রেকর্ড করে তারপর সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে। অর্থাৎ একজনের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে তিনজনের জন্মনিবন্ধন করাতে হচ্ছে। বর্তমানে যাদের বয়স ২১ বছর তাদের প্রত্যেকেরই জন্ম ২০০১ সালের পরে। এতে করে এদের প্রত্যেকের জন্মনিবন্ধন করার আগে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে। পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন নম্বর সন্তানের জন্মনিবন্ধন ফরমে দেওয়ার পরই তা রেকর্ড করা সম্ভব হচ্ছে। একজনের জন্য তিনজনের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে সংকট প্রকট হচ্ছে। পিতা-মাতার এনআইডি থাকলেও তার ওপর ভিত্তি করে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হচ্ছে না। পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন করার পরই কেবল সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদপত্র দেওয়া হচ্ছে।
কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, জন্মনিবন্ধন ব্যাপারটি সহজ করার সুযোগ থাকলেও তা না করে জটিল করা হচ্ছে। এত বেশি কাগজপত্র চাওয়া হয় যে, ওগুলো যোগাড় করতে গিয়ে পিতা-মাতার অনেক কষ্ট হয়। অনলাইন জন্মনিবন্ধনের নতুন নিয়মে শূন্য থেকে ৪৫ দিন বয়সী শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য টিকার কার্ড, পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র, বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাঙের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে হয়। ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্মনিবন্ধন নিতে টিকার কার্ড/স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যয়নপত্র (স্বাক্ষর ও সিলসহ প্যাডে হতে হবে), পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নপত্র, বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাক্সের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি; বয়স ৫ বছরের বেশি হলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র না থাকলে সরকারি হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাক্ষর ও সিলসহ প্রত্যয়ন সনদ এবং জন্মনিবন্ধন আবেদন ফরমের ৭-এর ১ নং কলামের স্বাক্ষর ও সিল বাধ্যতামূলক। যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক, যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির আগে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক, যদি জন্ম ২০০১ সালের আগে হয় সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা মৃত হলে মৃত্যুসনদ বাধ্যতামূলক। যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের পিতা-মাতা মৃত হলে প্রথমে অনলাইন জন্মনিবন্ধন গ্রহণ করার পর অনলাইন মৃত্যু নিবন্ধন সনদ গ্রহণ করতে হবে। উভয় সনদ আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাঙের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর এবং ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগে। আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া কাগজপত্র সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য/নারী সদস্যদের স্বাক্ষরসহ সিল বাধ্যতামূলক। এতসব কাগজপত্র যোগাড় করেও নিজের কিংবা সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য দিনের পর দিন মানুষকে ঘুরতে হচ্ছে। একজন অপারেটরকে এত সব কাগজপত্র যাছাই বাছাই করে ডাটা রেকর্ড করতে হচ্ছে, যা একজনের পক্ষে সম্ভব নয় বলে একাধিক কাউন্সিলর মন্তব্য করেছেন।
আবার যাদের মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই বা ভুল রয়েছে তাদের ভোগান্তি আরো বেশি। তাদেরকে ছুটতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন অফিসে। নির্বাচন কমিশনে নতুন এনআইডি করা কিংবা সংশোধন করার আগেই করতে হচ্ছে জন্মনিবন্ধন। আবারও ছুটতে হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা কাউন্সিলর কার্যালয়ে। সেখানে দীর্ঘ জটলার মুখে পড়তে হচ্ছে।
জন্মনিবন্ধনকালে যদি কোনো তথ্য ভুল হয় তাহলে দুর্ভোগ আরো বাড়ে। এসব ভুল সংশোধন করতে যেতে হচ্ছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। ইউপি চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জন্মনিবন্ধন সনদ দিলেও তিনি তা সংশোধন করতে পারছেন না। সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে ইউএনওকে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংশোধনের অনুমোদন নিয়ে যেতে হচ্ছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউপিতে। ওখানে গিয়ে সংশোধিত তথ্য দিয়ে সংগ্রহ করতে হচ্ছে জন্মনিবন্ধন। সেখানে যদি সার্ভার ডাউন থাকে তাহলে অপেক্ষার পালা বাড়তে থাকে।
জন্মনিবন্ধনের বাধ্যবাধকতায় বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানে ডাটাবেস তৈরির কাজ করা হচ্ছে। তবে ওখান থেকে অনলাইনে আবেদন জমা দেওয়া হলেও সনদপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। জমা দেওয়া আবেদন ফরম ও কাগজপত্র নিয়ে আবার ছুটতে হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদে। ওখান থেকে পাওয়া যায় চূড়ান্ত সনদপত্র। তবে কাগজপত্র সব গুছিয়ে আনার পরও সার্ভার ডাউন বা নেটের গোলমালে সনদপত্রের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই। দুর্ভোগ থেকে বাঁচার জন্য সহজ পন্থা বের করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
৮ নং শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদ আলম বলেন, প্রতিদিন মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন সনদপত্র পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। অথচ এই সনদপত্র ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। একজন অপারেটর দিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও ওয়ার্ডবাসীর দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হচ্ছে না।
জন্মনিবন্ধন নিয়ে মানুষের কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন বলেন, বিষয়টি সহজ করা হলে মানুষের উপকার হতো। কী করে সহজ করা যায় তা অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন প্রস্তাব নিয়ে জলবায়ু সম্মেলনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধআইসিইউতে সংকটাপন্ন আহত মাহাদি আকিব