চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে আছে (সিএমপি) নানা সংকট। জনবল সংকট, যানবাহন সংকট, সোর্স মানি সংকট, আগ্নেয়াস্ত্র সংকট, বাসস্থান সংকট, রেশন সংকটসহ নানা সংকটের ভেতর দিয়ে সিএমপির পুলিশ এতদূর এসেছে। সংকট এখনো আছে। এক হাজার একশজনের বিপরীতে বর্তমানে একজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। অভ্যন্তরীণ সংকটের সাথে আছে ভাবমূর্তির সংকটও। তাই প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পার হতে চললেও সংকটের আবর্তে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও দ্রুততম সময়ে জনগণের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর ১২৮ বর্গমাইল আয়তন ও দশ লক্ষ জনবসতিপূর্ণ বাণিজ্য ও শিল্প সমৃদ্ধ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ১৯৭৮ সালের ৪৮ নং অধ্যাদেশ বলে সিএমপির কার্যক্রম শুরু হয়। সিএমপি কমিশনারগণ প্রত্যেকেই সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বর্তমান কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়ও বলেন, নগরবাসীর মনে নিরাপত্তা বোধটা জাগ্রত করার জন্য আমরা কাজ করছি। নগরবাসী যেন আমাদের নিজেদের একজন ভাবতে পারেন, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সীমাবদ্ধতা সবসময়ই ছিল, আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এর মধ্যে যতটা পারা যায় করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা যেমন এখন কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে কাজ করছি, বিট পুলিশিং নিয়ে কাজ করছি। এসবের উদ্দেশ্য একটাই; অংশীদারিত্ব তৈরি করা। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা, যেন নগরবাসী পুলিশের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা তো ধারাবাহিক প্রসেস। এখান থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে চাই।
সিএমপির বিদায়ী কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর সিএমপিতে জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, এখানে জনবল সংকট রয়েছে। বেশ কিছু ইউনিটকে শক্তিশালী করতে পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর ৬টি থানা ও ৩ হাজার ৬২২ জনবল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সিএমপি। তখন মহানগরীর জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, বর্তমানে নগরীতে জনসংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এছাড়া ভাসমান জনসংখ্যা আরও ১৫ লাখ।
এই ৭৫ লাখ মানুষের নিরাপত্তায় রয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৭৪৮ জন পুলিশ সদস্য। অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ১০০ জন নাগরিকের সুরক্ষার বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ১ জন পুলিশ সদস্য, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে নগরীতে থানা রয়েছে ১৬টি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জনবল সংকটের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কাজের চাপ বাড়ে নগর পুলিশ সদস্যদের ওপর। এতে করে ঈদ–পূজা পার্বনে নির্ধারিত ছুটি–ছাটা থেকেও বঞ্চিত হন অনেকে। এছাড়া পরিবার পরিজনকে সময় দিতে না পারায় হতাশা এবং আক্ষেপও জানিয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এতে করে পুলিশ সদস্যদের সেবা দেওয়ার মানসিকতা কিংবা পুলিশিংয়ে প্রভাব পড়ছে।
সিএমপির তথ্যমতে, ১৯৭৮ সালে ২৭৬ জন নাগরিকের নিরাপত্তার বিপরীতে ছিলেন ১ জন পুলিশ সদস্য। ১৯৯০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতি ৪৬৫ জন নাগরিকের বিপরীতে ১ জন এবং ২০১৭ সালে এর আনুপাতিক হার ছিল প্রতি ১ জন পুলিশ সদস্যের বিপরীতে ৮৪৬ জন নাগরিক।
কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানা পুলিশের দায়িত্বের বাইরেও ৪ বিভাগে ট্রাফিক পুলিশ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অর্থাৎ কেপিআইয়ের (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) সুরক্ষা, ভিভিআইপিদের (রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের) প্রটোকল অ্যান্ড প্রটেকশন এবং অনান্য জরুরি কাজে তাদের নিয়োজিত থাকতে হয়। এছাড়া পুলিশ কন্ট্রোল রুম, রিজার্ভ অফিস, দামপাড়া পুলিশ লাইন্স, মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন্স, কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ, পোশাক ভান্ডার, রেশন স্টোর ও বিভিন্ন পুলিশ অফিসের দায়িত্ব থাকে। এর সঙ্গে আদালতে আসামি আনা–নেওয়া এবং চট্টগ্রাম সফররত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানদের প্রটোকলের দায়িত্বেও রাখা হয় পুলিশের একাধিক টিম।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ায় দেশি–বিদেশি উদ্যোক্তারা সিএমপি এলাকা ও এর আশপাশে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ শিল্প এলাকা গড়ে তুলেছেন। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ সেখানে কাজের জন্য আসছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি–রপ্তানির কার্যক্রম, জাহাজের আগমন– বহির্গমন, নাবিকদের আগমন–বহির্গমন আগের তুলনায় বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম নগরকে যুক্ত করেছে এক অন্য উচ্চতায়, যার কারণে এখানে লোকসমাগম ও বাণিজ্য সামনের দিনে আরও বাড়বে। এর পাশাপাশি বাড়ছে অপরাধের ঝুঁকি। আর মহানগরীতে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে জনবল সংকট ও লজিস্টিকস সাপোর্ট।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার বিভিন্ন সময়ে সিএমপির অপর্যাপ্ত জনবলের কথা সামনে এলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।