চট্টগ্রাম পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনাময় একটি জায়গা। এই চট্টগ্রামের আনাচে–কানাচে রয়েছে চোখ জুড়ানো–মন ভুলানো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চট্টগ্রামের প্রকৃতি খুবই সুন্দর। চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি মন কেড়ে নেয়। অজানা এক ভালোলাগা কাজ করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এমন প্রকৃতির মায়ায় মন ভুলে যায় বেদনার মুহূর্তগুলো।
চট্টগ্রামের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এমন পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে জনসমক্ষে তুলে ধরার নানান উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঢাকা–চট্টগ্রামের মহাসড়কের ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের একেবারে সন্নিকটে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ১৯৪ দশমিক ১৩ একর জায়গা উদ্ধার করা হয়। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে ‘ডিসি পার্ক’ নামে একটি দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এটি এখন চট্টগ্রামবাসীর কাছে অন্যতম বিনোদনের স্পট হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
আগে যেখানে ছিল মাদকের আখড়া। সেখানে মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যে চোখ জুড়ানো–মন মাতানো ফুলের সমাহার! বিস্তীর্ণ জলরাশি আর তার পাড় ঘেঁষেই ফুলের সাম্রাজ্য। শীতপ্রধান দেশের রানি টিউলিপ ফুল থেকে শুরু করে দেশীয় গাঁদা, লাল, নীল, হলুদ বর্ণের ডালিয়া ছাড়াও আছে নানা বর্ণের মেরিগোল্ড, চন্দ্রমল্লিকার মতো রঙ–বেরঙের ফুল। এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের দেখা মিলবে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে বন্দরের সংযোগ সড়ক মেরিন ড্রাইভের একাংশে। চোখ ধাঁধানো রঙ–বেরঙের এমন ফুলের এ সম্ভার নিয়ে ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক গড়ে তুলছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে একটু প্রশান্তি ও স্বস্তির খোঁজে এখন প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসছেন হাজারো ভ্রমণপিপাসু মানুষ। চোখজুড়ানো বর্ণিল এই ফুলের সমারোহ দেখে উচ্ছ্বসিত পর্যটকরা। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, পুরো
এলাকা ফুল ও জলাশয়ের সমন্বয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন পার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১২২ প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে এবং আরও লাগানো হবে।
তিনি বলেন, এই পুরো এলাকাকে ঘিরে আমাদের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। এখানে নারী–পুরুষ, শিশু–কিশোর, যুুবক, বৃদ্ধ সব বয়সী ও শ্রেণি পেশার মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য সাজানো হচ্ছে। নানান রঙের, নানান জাতের ফুলের পাশাপাশি এখানে গড়ে তোলা হবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সংরক্ষিত বন, সাইক্লিং ট্র্যাক, বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রসহ বণ্যপ্রাণীদের আবাসস্থল। থাকবে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থাসহ সাম্পানের ব্যবস্থাও। শিশুদের জন্য কিডস জোন, থাকবে মুক্ত আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন হল।
শুধু ফুলের সৌন্দর্য নয়, বিনোদন ও অবসর সময় কাটানোর জন্য এখানকার দুই জলাশয়ের মাঝখানে নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে, কটেজ। থাকবে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা। এছাড়া এখানে নৌকাবাইচ ও মাছ শিকারের ব্যবস্থা করা হবে। আর পুরো এলাকাকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে মাস্টার প্ল্যানের কথা জানান জেলা প্রশাসক।
তিনি বলেন, অপরূপ সৌন্দর্যের লীলা ভূমি চট্টগ্রাম। বিশ্বে এমন শহর খুব কমই আছে যেখানে একত্রে সবুজে ঘেরা পাহাড়, নদী আর সাগরের মেলবন্ধনের দেখা মেলে। প্রাচ্যের রানিখ্যাত চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে সুপরিচিত।
জেলা প্রশাসনের ছাদ খোলা পর্যটক বাস সার্ভিস : চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম নান্দনিক ও জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নান্দনিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে এই সমুদ্র সৈকতটির জনপ্রিয়তা পর্যটকদের কাছে দিন দিন বাড়ছে। কর্ণফুলী নদী ও সাগরের মোহনায় অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বিকেল এবং সূর্যান্তের সময় অগণিত পর্যটকের ঢল নামে। এছাড়া, চট্টগ্রাম শহরের ফৌজদারহাটে অবস্থিত জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম কর্তৃক নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ‘ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক’ ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এসব আকর্ষণীয় স্থান গুলোতে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য নির্ভর করতে হয় গণপরিবহন কিংবা উচ্চ ভাড়ায় চালিত পরিবহনের ওপর। ফলে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকরা তো বটেই চট্টগ্রামের ভ্রমণ পিপাসুদের নানান ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
পর্যটকদের ভোগান্তি কমাতে এবং নিরাপদ ভ্রমণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষ ছাদ খোলা বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। এই ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা পর্যটনপ্রেমীদের ডিসি পার্ক ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে দুটি ডাবল ডেকার (একটি ছাদ খোলা) বাস দিয়ে পর্যটক বাস সার্ভিস চালু করেছি। একই সাথে মাইক্রোবাস এর মাধ্যমে ‘হাফ ডে এবং ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’ চালু করেছি। ভবিষ্যতে আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকত, ইউরোপীয়ান ক্লাব, বাটালী হিলসহ অন্যান্য জায়গায়ও এই সার্ভিস চালু করবো। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এবং ফৌজদারহাটস্থ ডিসি পার্কের গমনাগমন নির্বিঘ্ন ও সহজতর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের সহযোগিতায় টাইগার পাস থেকে পর্যটক বাস দুটি চালু করেছি।
সার্ভিসটি প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা, বিকাল ৩টা, বিকাল ৪টায় মোট ৩টি ট্রিপ পরিচালনা করে। এছাড়া প্রতি শনিবার চলে ৪টি ট্রিপ। ট্রিপগুলো যথাক্রমে সকাল সাড়ে ৯টা, সকাল সাড়ে ১০টা, বিকাল ৩টা ও বিকাল ৪টায় যাত্রা করে। এছাড়া প্রতি রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন ২টি ট্রিপ যথাক্রমে বিকাল ৩টা ও বিকাল ৪টায় চট্টগ্রামের টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গার উদ্দেশ্য যাত্রা করে।
পতেঙ্গা থেকে ফেরার সময় : শুক্রবার তিনটি ট্রিপ যথাক্রমে দুপুর ১২টা, সন্ধ্যা ৭টা, রাত ৮টা, শনিবার চারটি ট্রিপ যথাক্রমে দুপুর ১টা, দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা, রাত ৮টায় পতেঙ্গা থেকে একই রুটে ফিরে আসবে। পর্যটক বাস সার্ভিসে ভ্রমণের জন্য টাইগার পাস থেকে ডিসি পার্ক ৪০ টাকা, ডিসি পার্ক থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ৩০ টাকা, টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ৭০ টাকা করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে পতেঙ্গা থেকে ডিসি পার্ক ৩০ টাকা, ডিসি পার্ক থেকে টাইগারপাস ৪০ টাকা, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে টাইগারপাস ৭০ টাকা টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’: পর্যটক বাস চালুর পর এবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চালু হয়েছে ‘ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’। ইতোমধ্যে এই সার্ভিস ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সপ্তাহে দুইদিন শুক্রবার ও শনিবার জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় দিনব্যাপী এ কার্যক্রমে ভ্রমণ পিপাসুদের দিনদিন আগ্রহ বাড়ছে। এতে দুপুরের লাঞ্চসহ যাত্রী প্রতি খরচ পড়ছে ৮৫০ টাকা।
শুক্র ও শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন রোড এলাকায় মোটেল সৈকত থেকে ৪টি মাইক্রোবাসে করে ৪০জন যাত্রী নিয়ে ফুল ডে ট্যুর সার্ভিসের যাত্রা শুরু করে।
এই উদ্যোগের ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের পর্যটন খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে প্রথমবারের মতো ‘হাফ ডে ও ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’ চালু করেছি। প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগ কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি খুব সংকিত ছিলাম। চালুর পর দেখলাম–এই উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দিনদিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি সেবার জন্য, ব্যবসার জন্য নয়।
হাফ ডে ও ফুল ডে ট্যুর সার্ভিসে মোটেল সৈকত থেকে যাত্রীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে মহামায়া লেক হয়ে সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক। পার্কের ভিতরে থাকা সহস্রধারা ও সুপ্তধারা দুটি ঝরনা দেখে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত হয়ে ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক ভ্রমণ, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হয়ে আবার হোটেল সৈকতে ফিরে আসে। ভবিষ্যতে আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকত, ইউরোপীয়ান ক্লাব, বাটালী হিলসহ অন্যান্য জায়গায়ও এই সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।