বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেন এখন মহাসড়কে উঠে গেছে। তারিখ ঘোষণা না হলেও আশা করা যায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কোন কোন দল প্রার্থী বাছাই এর কাজটাও সেরে নিচ্ছেন সুকৌশলে। জাতি অপেক্ষা করছে নির্বাচন এর জন্য। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের জন্য নির্বাচন একটি উত্তম পন্থা এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে ও সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ মূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন সবার প্রত্যাশার তুঙ্গে ।
রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করে নিজেকে উজাড় করে দেয়া। দেশ সেবার প্রকৃত সুযোগ হলো রাজনীতিতে অংশগ্রহণপূর্বক নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার লড়াইয়ে নামা। সে নির্বাচন হতে পারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, জেলা পরিষদ কিংবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ইত্যাদি।
তবে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার অভিলাষ যদি হয় ক্ষমতার চরকা ঘুরিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা এবং অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে দাপটের সাথে সমাজে বিচরণ করা, তেমন রাজনীতি না করাই সুবিবেচকের কাজ হওয়া উচিত। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে আমার সত্তর দশকের জীবনে আমি কখনও কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ কিংবা ঘৃণাও নেই। তবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সবকিছু আমি পর্যবেক্ষণ করি। স্বচ্ছ ধারার রাজনীতি করে সততা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত যে সব ক্লিন ইমেজের জাতীয় নেতৃবৃন্দ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ রক্ষার জন্য জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের প্রতি রইলো আমার হাজারো সালাম ও শ্রদ্ধা। ৭১ এর বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও ২৪ এর জুলাই বিপ্লবের শহীদ বীর ছাত্র জনতার আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আহতদের প্রতি রইলো গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা।
দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে হয়তো কিছু ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে তবে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া ঠিক নয় যার জন্য সারা জাতিকে তার খেসারত দিতে হয়। সব জনপ্রতিনিধিকে একই মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক নয়। স্বচ্ছতার সাথে যারা রাজনীতি করেছেন, যাদের হাতে জনগণ কখনও নিপীড়িত বা নির্যাতিত হননি, কিংবা ন্যায় বিচার থেকে কেউ কখনও বঞ্চিত হননি তেমন নেতার কথা জনগণ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে চিরকাল।
স্বাধীনতার পর থেকে সারা জাতি দিব্য দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছে এদেশে কিছু কিছু রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের কী ভূমিকা ছিল এবং তারা কী করেছে। সীমাহীন দুর্নীতি, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদানের জন্য টাকা বিলিয়ে জনবল নিয়োগ করে অবৈধ পন্থায় এরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রকাশ পায় এদের আসল রূপ। ক্ষমতার জোরে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া, বিপুল বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয়ে দেশে বিদেশে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করে জায়গা জমি ক্রয় ও বাড়ি ঘর তৈরী করে আরাম আয়েশে জীবন যাপন এর মহা আয়োজন দেখে দেশের মানুষের চক্ষু চড়ক গাছ। এরা নির্বাচন কালে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর সব ভুলে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব জন প্রতিনিধিদের কোন ভাষায় গণ মানুষের নেতা বলা হয় বুঝি না। রাজনীতির নামে এরা শুধু যে জনগণের সাথে প্রতারণা করে তাই না, এদের মহা দুর্বৃত্ত বলতেও কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করা, বিদেশে টাকা পাচার করা, সরকারি খাস জমি দখল, সাধারণ মানুষের জায়গা জমি দখল, খুন গুম সহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত এসব দুবৃর্ত্তরা কোন ধরণের রাজনীতিবিদ বা জন প্রতিনিধি তা বোঝা বড়ই কঠিন। এরা বুঝতে অক্ষম যে আত্নবিনাশী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে এরা সমাজের এবং দেশের সর্বনাশ করছে। যাদের বিবেকের পারদ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে তারাই হলো এসব দুষ্কর্মের মূল হোতা।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার পর নানা সেক্টরে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছেন। বিগত সরকারগুলোর আমলে সৃষ্ট নানা অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি ও বহুমাত্রিক অপরাধের তদন্ত চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য। সংস্কার কমিশন গঠন করে সুশীল সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সমম্বয়ে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে তাদের সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ পত্র প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে জমা দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক মত বিনিময় চলছে। সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশগুলো যেন টেকসই ও সর্বজন সমর্থিত হয় সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখার গুরুত্ব অনেক। সুশাসন এবং জবাবদিহিতার বিধান থাকলে অপরাধ সংঘটনের লাগাম টেনে ধরা যায়। কোন কোন দল নির্বাচনের দাবী জানাচ্ছেন। আবার অন্য কয়েকটি দল সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনের কথা বলছেন। উভয় দলের চাওয়া যে অযৌক্তিক তা আমি বলছি না, আজ হোক কিংবা কাল হোক নির্বাচন তো অবশ্যই হবে, কারণ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হলে অবশ্যই জনগণের ভোটে একটি গ্রহণ যোগ্য নির্বাচিত সরকার দরকার। তবে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের প্রধান কাজ হবে রাষ্ট্র যন্ত্রকে মেরামত করে অতীতের ভুলগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সতর্ক থাকা। নির্বাচিত সরকারকে যা করতে হবে তা হলো –
জাতীয় সংসদ হতে হবে জবাবদিহিতামূলক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ পূর্বক সর্বসাধারণে আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে এমন ধরনের শাসন কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করা। বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। মৌলিক অধিকার এর ভিতকে শক্তপোক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা এবং সবার জন্য আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। অহেতুক যেন কোন নাগরিক হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা। শ্রেণি বৈষম্য দূর করে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নে ও দারিদ্রতা বিমোচনের কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। বেকার সমস্যা সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সকল সমপ্রদায়ের নাগরিক যেন নিরাপদে ও ভয়হীন চিত্তে যার যার ধর্ম পালন করতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে কালোবাজারি, মজুদদারি ও সিন্ডিকেট এর বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা।
প্রাথমিক স্তর থেকে উপযুক্ত মান সম্পন্ন শিক্ষাক্রম চালু করা, কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সকল শ্রেণির নাগরিকদের জন্য উন্নত মানের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে এ খাতে বিরাজমান সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করে তা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নানা অপকর্ম ঠেকাতে কমিউনিটি পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো সহ এলাকা ভিত্তিক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সুশাসন কায়েম করে বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি কল্যাণমূলক রাষ্টের মর্যাদায় আসীন করা।
অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল যেন প্রতিটি নাগরিকের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে পারে সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। এ জাতি লুটপাট, হানাহানি, সন্ত্রাস, খুন, গুম ও অস্থিতীশীল কোন কর্মকাণ্ড আর দেখতে চায়না। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে আমরা যেন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি তার জন্য সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে, মনে রাখতে হবে কোন পরাশক্তি নয়, সচেতনতা, ধৈর্য ও সাহসের সাথে আমরাই চেষ্টা করবো ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে, দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে সকল সংকটের মোকাবিলা করে একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।
লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।












