অনেক গুণ ও পরিচয়ে তিনি দেশে এবং বিদেশে সমান পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। ছিলেন বাম–প্রগতিশীল রাজনীতির সামনের কাতারের অগ্রসৈনিক, যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর যুগ্ম কমান্ডার। শোষণ–বঞ্চনার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী ও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ব্যক্তিত্ত্ব হচ্ছেন জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদ। ১৯৮৬ সালে পটিয়া আসন থেকে তিনি ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে যেমন তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার বক্তব্যে গণমানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেছেন জোরালো কণ্ঠে, তেমনি এলাকার উন্নয়নে রেখেছেন কার্যকর ভূমিকা। ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর জননেতা চৌধুরী হারুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ বেডে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে চৌধুরী হারুনর রশীদের নামের সাথে সেই ১৯৭২ সাল থেকেই পরিচিত। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থেকে কীভাবে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতেন সেসব কাহিনি তখন শুনতাম। পরে বিভিন্ন সভা সমাবেশে তাঁকে দেখেছি, তাঁর সুচিন্তিত জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনেছি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) তৃতীয় জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনে সারাদেশের শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এসে জমায়েত হন পলোগ্রাউন্ড ওয়াজিউল্লাহ্ ইনস্টিটিউট ও সংলগ্ন মাঠে। মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত হয় কাউন্সিল অধিবেশন। সম্মেলনে চৌধুরী হারুন এবং সাইফুদ্দীন মানিক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে পুন:নির্বাচিত হন। আমি তখন বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের নির্বাচিত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। টিইউসি জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির অভ্যর্থনা উপ–পরিষদে সদস্য হিসেবে আমাকে রেখেছিলেন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা অগ্রজপ্রতীম তপন দত্ত। তপন‘দার আহবানে আমি চারদিন সার্বক্ষণিক সম্মেলনের কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম এবং আমার সৌভাগ্য হয় শ্রমিক আন্দোলনে কিংবদন্তিসম চৌধুরী হারুনর রশীদকে কাছ থেকে দেখার। ক্লিনশেভড্ স্মার্ট পোশাক–পরিচ্ছদ এবং আচার–আচরণ সবকিছুতেই একটা আভিজাত্যের ছাপ। তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল খুবই সমৃদ্ধ। দেশ–বিদেশের যে কোনো ঘটনাপ্রবাহ বা খুঁটিনাটি বিষয় ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাঁর জ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে তাঁকে দেশে এবং বিদেশে একজন তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবী হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। শ্রমিকশ্রেণির তিনি ছিলেন দরদী বন্ধু এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে তিনি ছিলেন অটল–অনড় ও নিবেদিত জন। ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
১৯৫২ সালে চৌধুরী হারুনর রশীদ রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে। নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম ভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম–আহবায়ক। ৫২‘র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে। গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকে। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী সেদিনই রচনা করেন তাঁর অমর কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কবি অসুস্থ থাকায় চৌধুরী হারুনর রশীদ ছিলেন এর শ্রুতিলেখক এবং পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে আগুনঝরানো দ্রোহের কবিতাটি তিনি পাঠও করেন। কবিতাটি আজাদী‘র মুদ্রণশালা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে ছাপা হয়ে বিলি হয়েছিল। এই কবিতা পাঠের অপরাধে ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন চৌধুরী হারুন। একনাগাড়ে চার বছর কারাভোগের পর ১৯৫৬ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর কৃপানলে পড়ে তাঁকে পালিয়েই বেড়াতে হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর সামরিক শাসন জারি করে নির্যাতন–নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাতে শুরু করেন প্রগতিশীল গনতান্ত্রিক শক্তির ওপর। পাইকারি হারে চলে গ্রেফতার। চৌধুরী হারুনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে জারি করা হয় হুলিয়া। চৌধুরী হারুনের মুক্ত বাতাসে বিচরণের পথ সেই থেকে রুদ্ধ হয়ে যায়। আত্মগোপনে থেকে ছদ্মনাম ও বেশে চালিয়ে যেতে থাকেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জনতার সংগঠন–আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ। অংশ নেন ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে এবং তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ–কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর যুগ্ম–কমান্ডার ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও চৌধুরী হারুনর রশীদ। এই গেরিলা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাহসী অপারেশন চালিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তুলেছিল।
রাজনৈতিক জীবনে চৌধুরী হারুন দীর্ঘ ১২ বছর কাটিয়েছেন আত্মগোপনে। এসময় তিনি নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পরে সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে প্রকাশ্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাঁর কর্মস্থল হয় ঢাকা। তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি টিইউসির কর্মকাণ্ডে নিজেকে উজাড় করে দেন। টিইউসি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে একটি বৈপ্লবিক ধারার সূচনা করে। শ্রমিক আন্দোলন মানে যে লুটপাট ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা নয় তা উপলব্ধি করিয়েছে শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনার মানকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে। তিনি আইএলও কনভেনশন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের মনসা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরী হারুন। মনসা আশরাফ আলী চৌধুরীর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী তিনি। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটিয়া আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এই পদকে তিনি নিজের বিত্ত–বৈভব গড়ার কাজে ব্যবহার করেন নি। অর্থবিত্তের পেছনেও ছোটেন নি। শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে বিদেশে নামী–দামী হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ তাঁর হয়নি। এমন কী হাসপাতালের কেবিনেও না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সাধারণ বেডে দীর্ঘসময় চিকিৎসাধীন থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মহান এই ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধে বীর গেরিলা কমাণ্ডার চৌধুরী হারুনের নামে নগরীর বাটালি রোডের নামকরণ করেছিল। কিন্তু তার কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয় না কোথাও। বিষয়টি কর্পোরেশন দেখবে এই প্রত্যাশা রাখি।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।