এটি সর্বজনবিদিত যে; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথার্থ ধারণ ও পরিচর্যা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে উন্নয়ন–অগ্রগতির প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ। আপামর জনগণের সামষ্টিক চিন্তা–চেতনার প্রতিফলনে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অবাধ–সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। মূলতঃ সকল দল–মতের সম্মিলিত অংশগ্রহণ–সমর্থনে নেতৃত্ব বাছাই এবং সঠিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গণতন্ত্রকে শক্তিমান করে। গণতন্ত্র হলো আধুনিক বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমাদৃত শাসনব্যবস্থা যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্রই সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বিপুল পরিবর্তন–পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানেও গণতন্ত্র সমধিক জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। গণতন্ত্র যেকোন সমাজে পরিশুদ্ধ পন্থায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসন বা রীতি–নীতির পরিশুদ্ধতায় গণতন্ত্রের সাবলীল ধারণা–ধারাবাহিকতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যিক সৌকর্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান। সুদৃঢ় কাঠামোয় গঠিত দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের নির্ভরতম দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন পরিক্রমায় অংশগ্রহণে আগ্রহী সকল রাজনৈতিক দলকে প্রচার–প্রচারণায় একই ধরনের সুযোগ–সুবিধা প্রদান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। দেশের প্রকৃত ভোটারদের নিঃসঙ্কোচে–নির্বিঘ্নে ভোটক্রেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ সংবিধান সম্মত। ভোট গ্রহণের আগে ও পরে প্রত্যেক নাগরিকের বিশেষ করে ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পছন্দের দল–প্রার্থীকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জয়যুক্ত করার নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দল নিরপেক্ষ ভূমিকা অপরিহার্য। অর্থ–ক্ষমতা–পদ–পদবীর প্রলোভনে কোন ধরনের ব্যত্যয় সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় সহায়ক নয়। অপসংস্কৃতির মোড়কে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন বা অন্যকোন কদর্য পন্থায় ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া সর্বত্রই পরিত্যাজ্য। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যেক স্তরে জনগণের অংশগ্রহণই মুখ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যথার্থ অর্থে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াই গণতন্ত্রের পথকে সুগম করে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বের ও গণতন্ত্র অনুশীলনে ঋদ্ধ দেশ সমূহের উন্নয়ন দৃষ্টান্ত সকল দেশের জন্যই শিক্ষণীয়।
ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটারবিহীন নির্বাচন ও সময়ের আগে রাতের অন্ধকারে ব্যালট বক্স ভর্তিসহ নানামুখী হীন কর্মকান্ড ইতিপূর্বে বেশকয়েকটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিচ্যুতি কারো কাম্য নয়। হত্যা–সন্ত্রাস–বলপ্রয়োগ–নিপীড়ন–নির্যাতনের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ কখনো গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। হয়রানি–বিদ্বেষমূলক নামে বেনামে গায়েবি মামলা–হামলায় সমাজের স্বাভাবিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করার দৃষ্টান্ত সভ্যসমাজে বিরল। এসব কুৎসিত কর্মযজ্ঞের ফলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অর্থ আত্মসাৎ–ঘুষ–দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করে। তাদের অবৈধ পন্থায় অনৈতিক উপার্জনে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার বিপুল ঘটনায় ইতিমধ্যে দেশবাসী হতবাক। কৃর্তত্ববাদী বা স্বৈরচারী অপশক্তি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার সকল ধরনের অপকৌশল সমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত। সাধারণ জনগণের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন গভীর প্রত্যাশায় উজ্জীবিত।
আমাদের সকলের জানা, নির্বাচন কমিশন হলো একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা। স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, সংসদ ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অবাধ–নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে সাংবিধানিকভাবে শপথের দ্বারা দায়বদ্ধ। সংস্থাটি দেশের নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোটগ্রহণ তত্ত্বাবধান, নির্বাচনের সামগ্রিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনার উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ–মামলা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নির্বাচনী ট্রাইবুনাল গঠন করা নির্বাচন কমিশনের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের সংবিধানের ৭ম ভাগে নির্বাচন কমিশনের গঠন–কাঠামো, ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারগণকে নিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন থাকবে। উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগদান করবেন। একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর সভাপতি রূপে কাজ করবেন। সংবিধানের বিধানবলি সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তাঁর কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছর কাল হবে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এমন কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন না। অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনার অনুরূপ পদে কর্মাবসানের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার রূপে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন। তবে অন্য কোনোভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী প্রয়োজন হবে, নির্বাচনের কাজে সহায়তার লক্ষ্যে সেরূপ কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার ও ৪টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে। জনশ্রুতি মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত নির্বাচনগুলো ছাড়া বাকি সব নির্বাচনই ছিল নানাভাবে বিতর্কিত। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার বড় আকারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মুলত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও তাদের শরিক দলের প্রার্থীরা ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৯০ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকে এ নির্বাচন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহত হন ১২৩ জন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের হার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান নিয়ে দেশি–বিদেশি গণমাধ্যমে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নানা অভিযোগ উত্থাপন করে। জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। অনেকের মতে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ, বেসামরিক প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। তারা সকলেই ছিল একে অপরের সহযোগী।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশন (ইসি)সহ ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাসী। তাই নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়ন সরকারের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর মতে, ‘নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপরে চাপিয়ে দেয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আকাঙ্ক্ষা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি। নির্বাচনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্ভাব্য সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গণমাধ্যমে বলেন, ‘এখনো কমিশনের টার্ম অব রেফারেন্স কি হবে সেটা পাই নি। তবে যতটুকু বুঝতে পারছি এই কমিশনের কাজ হবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। যাতে নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এবং ছাত্র–জনতার আন্দোলনের যে মূলমন্ত্র রাষ্ট্র সংস্কারে সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।’ বহুল প্রতিক্ষীত সুষ্ঠু–স্বাধীন নির্বাচনে অবাধ মুক্ত পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের গভীর আকাঙ্ক্ষায় আপামর জনগণ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেশে–বিদেশে অনুষ্ঠিত প্রকৃত অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিবেচনায় সরকার গঠন সমধিক প্রত্যাশিত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মাবলী অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠান রাষ্ট্রের মর্যাদাকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে। যৌক্তিক সংস্কার সম্পন্নে আগামী দিনের নির্বাচন জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অপরাজিত থাকুক।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়