জঙ্গি দমনে মাস্টারপ্ল্যান

অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটে ৬ শাখা ও দুটি বিশেষ গবেষণা সেল

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ২৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

জঙ্গি দমনে মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রতিরোধসহ জ্ঞাননির্ভর অপারেশনাল সক্ষমতা, মানসম্মত তদন্ত ও প্রসিকিউশন এবং সর্বোপরি উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এ ইউনিটের মূল মিশন। এছাড়া সাইবার অপরাধ ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে বিশেষ কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে সংস্থাটি।

এটিইউ তাদের এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে ১ হাজার ২১৯ জন জামিনপ্রাপ্ত, কারাবন্দি ও পলাতক জঙ্গির তথ্য সংগ্রহ করে প্রোফাইল সম্পন্ন করেছে। এছাড়া ন্যাশনাল টেলিকমিনিকেশনড মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) স্বতন্ত্র এজেন্সি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দুইটি ইউনাইটেড ইউজার স্টেশন (ইউইউএস), একটি এলআইএমএস ও ৩৫০টি নম্বর বরাদ্দ নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিংয়ের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে স্থাপিত সার্ভার থেকে দুইটি ইউজার কানেকশন পেয়েছে। এছাড়া বোম ডিস্পোজাল বিভাগের অধীনে দু’টি গবেষণা সেল তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে জঙ্গিদের গতিবিধি নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি অভিযানের সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে দুই শতাধিক সদস্যকে সোয়াট ও কমান্ডো ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও ডায়ালগে বিভিন্ন র‌্যাংকের ৪৯ জন পুলিশ সদস্যকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। জঙ্গিদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংগ্রহের পথ রোধ করতে বিভিন্ন রুট চিহ্নিত করে গোপন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

জানতে চাইলে এন্টি টেররিজম ইউনিটের অপারেশন শাখার পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন জানান, জঙ্গিদের এখন হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা নেই। অনলাইনে কিছু উগ্রবাদী লোকজন সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া বিছিন্নভাবে কিছু সদস্য রয়েছে। তারা বর্তমানে নিষ্ক্রিয় থাকলেও তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি রাখা হয়েছে। এজন্য অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটে দু’টি গবেষণা সেল তৈরি করা হয়েছে। একটি অস্ত্র ও অপরটি বোমা বিষয়ে। তারা জঙ্গিদের এ ধরনের কার্যক্রম মনিটরিং করছে। মোস্ট ওয়ানটেডদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দ্রুত অভিযান পরিচালনার জন্য দেশের ৮ বিভাগে ইউনিটের আঞ্চলিক কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। শিগগিরই পূর্বাচলে নিজস্ব ভবনে ইউনিটের কার্যক্রম শুরু করা হবে। ঢাকা মেট্রো অফিসও থাকবে সেখানে। এছাড়া ইউনিটের অন্তত ২ শতাধিক সদস্যকে সোয়াট ও কমান্ডো ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তারা যেকোনো ধরনের অপারেশন চালাতে সক্ষম।

এসপি সানোয়ার হোসেন আরও জানান, আগে জঙ্গিরা পুরান ঢাকার বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিস্ফোরক ক্রয় করত। বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে আসার পর ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের ডেকে পাঠানো হয়। এরপর যাচাই না করে এসব বিস্ফোরক কারও কাছে বিক্রি না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জঙ্গিরা যাতে সহজে বারুদ সংগ্রহ করতে না পারে এজন্য ম্যাচ ফ্যাক্টরির কর্মকর্তাদের কাঠির মাথায় বারুদের পরিমাণ কমিয়ে তুলনামূলক দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। কেননা গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিরা ম্যাচের কাঠির বারুদ বোমার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছে।

জঙ্গি দমনে মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে ৬টি শাখায় বিভক্ত করে সাজানো হয়েছে এই বিশেষ ইউনিটকে। এরমধ্যে, সোয়াত টিম, ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন টিম, বোম্ব বিস্ফোরণ ইনভেস্টিগেশন টিম, ক্রাইসিস ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম, এক্সপ্লোসিভ ডিসপোজাল টিম ও কেনাইন স্কোয়াড (ডগ স্কোয়াড) অন্যতম। এছাড়া রয়েছে দু’টি বিশেষ গবেষণা সেল।

সূত্রমতে, জঙ্গিদের দুর্বল করতে তাদের অস্ত্র ও বিস্ফোরকের উৎস বন্ধ করতে গবেষণা সেল দুটি কাজ করছে। তারা বিভিন্নস্থানে বিস্ফোরণের ধরন সম্পর্কে অনুসন্ধান করছে। পরবর্তী সময়ে সেখানে ব্যবহৃত রাসায়নিক সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তার আমদানিকারকের বিষয়ে তথ্য নিয়ে ক্রেতা সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে ডাটাবেইজ তৈরি করছে। এছাড়া ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কেও একটি গবেষণা সেল তৈরি করা হয়েছে। ওই সেলের সদস্যরা দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে কোন মতাদর্শের জঙ্গিরা কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। এছাড়া তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সীমান্তের দু’টি পথে জঙ্গিরা অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করে। এর মধ্যে একটি পাহাড়ি পথ, অন্যটি নদীপথ। নদীপথ হিসেবে তারা ব্যবহার করছে উত্তর বঙ্গের একটি জেলাকে। এবং পাহাড় হিসেবে বেছে নিয়েছে পার্বত্য অঞ্চলকে। ফেনী ও আরও একটি জেলা থেকে পর্যায়ক্রমে হাতবদল হয়ে জঙ্গিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে অস্ত্র এসেছে। এ কারণে ওইসব এলাকার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতে এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই ইউনিটের কার্যক্রমে তেমন একটা গতি দেখা না গেলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই সংস্থা পরিচালনার বিধিমালার অনুমোদন হয়ে গেলে এর কার্যক্রমে গতি পাবে। তখন সারাদেশে পুরোদমে জঙ্গিসন্ত্রাসবাদ দমনের জাতীয় সংস্থা হিসেবে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট তাদের কাজ চালাতে পারবে বলেও জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রধান টার্গেট করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিবাদ বিরোধী পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা ‘অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গিদের প্রধান টার্গেটই হচ্ছে শিক্ষার্থী, কিশোর ও তরুণরা। তাই কীভাবে তাদের জঙ্গিবাদের থাবা থেকে রক্ষা করা যায়, সেদিকেই খেয়াল রাখছে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম চালানো হচ্ছে পুরোদমে। এছাড়া দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে কীভাবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই কাজ চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি ডাব ১৫০-১৮০ টাকা!
পরবর্তী নিবন্ধট্রাম্প গ্রেপ্তার, ২০ মিনিট পর জামিন