কয়েক মাস পরই দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে–বিদেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টিকে সামনে রেখে সন্ত্রাস ও নাশকতা ছাড়াও জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য জানাতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার বিশেষ কোনো মতামত বা সুপারিশ থাকলে সেটাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখাকে জানাতে বলা হয়েছে। কোরবানির ঈদের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে সংঘটিত নজিরবিহীন ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাবসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ ও দমনে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার পর ‘অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট’ নামে পুলিশের আলাদা বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নির্মূল হয়নি এখনও। মাঝে মধ্যেই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত পাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। তাদের অবস্থান সম্পর্কে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। তবে এরই মধ্যে গত ২৩ জুন রাতে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে সপরিবারে গ্রেপ্তার করা হয়। তার স্ত্রী নাজনীনও এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে নারীদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতো বলে জানায় সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এই শামিন মাহফুজই। গত ৬ মাসে সিটিটিসি জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। জঙ্গিদের নানামুখী তৎপরতা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাদের সব কার্যক্রমও নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা নির্দেশনামূলক একটি প্রতিবেদন গত ৬ জুন পাঠানো হয় সব সংস্থার প্রধানদের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার আগে থেকেই জঙ্গিরা টার্গেট কিলিং শুরু করে। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে সন্ত্রাস, নাশকতা ও জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদী ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনার আলোকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সাধারণ মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করার পাশাপাশি উগ্র ও জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালু রেখেছে। কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিকৃত প্রচার–প্রচারণার বিরুদ্ধে পুলিশের উদ্যোগে কাউন্টার ন্যারেটিভ বা প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে জঙ্গি ও উগ্রবাদ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইমামদের মাধ্যমে জুমার নামাজের খুতবায় জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রচলিত আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছিল তিন হাজার ৭৮৬টি। এরমধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় ৩ হাজার ৫৪৯টির। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১৮৬টি মামলার। নানা কারণে এখনও তদন্ত শেষ হয়নি ৫১টি মামলার। এছাড়া ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওই বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হয়েছিল এক হাজার ৮২৬টি মামলা। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭৮৯টির, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় ৩৩টি মামলার। ৪টি মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তাধীন মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা, অভিযোগপত্র দেওয়া মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া মনিটরিং করা এবং স্থগিত মামলাগুলো সচল করার ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।