জঙ্গল সলিমপুরে দেশি বিদেশি অস্ত্রসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার

রাতভর র‌্যাবের অভিযান

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মশিউরের আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার মুখে পড়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৭)। এ সময় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাতে গিয়ে র‌্যাবও ১২৯ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। র‌্যাবের অভিযানের মুখে সন্ত্রাসীরা রাতের অন্ধকারে দুর্গম পাহাড়ি পথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। র‌্যাব অধিনায়ক এম এ ইউসুফের
নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হয়। গত শনিবার রাত সাড়ে নয়টা থেকে গতকাল রোববার ভোর পর্যন্ত রাতভর ধারাবাহিক এই অভিযান চলে। অভিযানের সময় অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী মশিউরের ছেলে শিবলুর আস্তানা থেকে ১০টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, একটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি ধারালো ছোরা এবং ২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও তাদের আস্তানা থেকে মিলিটারি গেজেট, মিলিটারি পোশাক, বাইনোকুলার, অবৈধ ধাতব মুদ্রাও উদ্ধার করা হয়েছে।
অভিযানে আটককৃতরা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার চক্তনখোলা গ্রামের মৃত শামসুল হকের ছেলে রফিকুল ইসলাম মালু (৪১), লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানার উপরামারা গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের ছেলে মো. সিরাজুল ইসলাম (৩৪), সীতাকুণ্ড থানার জঙ্গল সলিমপুর এলাকার মৃত মজিদ শেখের ছেলে জামাল শেখ (৪৭), চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তী থানার আহম্মদ নগর এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. হাসান (৩৫) এবং বাঁশখালী থানার ছনুয়া ইউনিয়নের আহমদুর রহমান ফারুকীর ছেলে মিজানুর রহমান কদর। আটককৃতদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম মালুর বিরুদ্ধে নগরীর বায়েজিদ থানায় ১টি, সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৫টি অস্ত্র মামলা, মো. হাসানের বিরুদ্ধে ৭টি, জামাল শেখের বিরুদ্ধে ১০টি, মিজানুর রহমান কদরের বিরুদ্ধে ১০টিরও অধিক মামলা রয়েছে।
অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল যে জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও সরকারি জমিতে প্লট তৈরি করে লোকজনের কাছে বিক্রি করে টাকা আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘদিন যাবৎ এমন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সন্ত্রাসী মশিউরের ছেলে শিবলু নিজের বিদ্যুতের মিটার থেকে দরিদ্র লোকজনের বাসায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এর মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত বৈদ্যুতিক মূল্যের চেয়ে অধিক অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। শনিবার রাতে সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা অপরাধ সংগঠনের জন্য একটি স্থানে জড়ো হয়েছে জেনে র‌্যাব-৭ অভিযান শুরু করে। অভিযানের শুরুতে পাঁচজনকে আটক করে র‌্যাব। পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আস্তানা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করে র‌্যাব। এ সময় সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অভিযানকারী র‌্যাবের দল ওই আস্তানা ঘিরে অবস্থান নেয়। পরে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করে দ্বিতীয় দফা অভিযান শুরু হয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ও ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। জবাবে র‌্যাবও আত্মরক্ষার্থে ১২৯ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। হামলার সময় সন্ত্রাসীদের ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন র‌্যাব সদস্য আহত হন। শেষে মশিউরের আস্তানা থেকে অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়। শীতের সময় সেনাসদস্যরা ইউনিফর্মের ওপর যে পোশাক পরেন একই ধরনের কয়েকটি পোশাক আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো কিনতে পাওয়া যায়।
র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) নুরুল আবছার জানান, শনিবার রাতে শিবলুর ঘরে অভিযানে যায় র‌্যাবের একটি টিম। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সকলে পালানোর সময় র‌্যাব ধাওয়া দিয়ে ৫ জনকে আটক করে। পরে আটককৃতদের নিয়ে অভিযান গেলে শিবলুর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে র‌্যাবের ওপর আক্রমণ করে আসামিদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে পাহাড়ের উপর থেকে গুলি ছোঁড়ে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় র‌্যাবের কয়েকজন সদস্যও আঘাত পান। পরে র‌্যাব এলাকাটি ঘিরে ব্যাপক ফোর্স নিয়ে অভিযান চালায়। অভিযানে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের ভিত্তিতে তিনটি অস্ত্র মামলা ছাড়াও র‌্যাবের উপর আক্রমণ, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে একটি র‌্যাব এ্যাসল্ট মামলা ও মিলিটারি উপকরণ রাখা ও অবৈধভাবে ধাতব মুদ্রা রাখায় একটিসহ মোট ছয়টি মামলা রুজু করা হয়েছে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা দীর্ঘ দিন ধরে সীতাকুণ্ড থানার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, সরকারি জমি প্লট আকারে লোকজনের কাছে বিক্রি করে টাকা আদায় করে আসছিল। এছাড়াও উক্ত এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং নিজেদের অপরাধকর্ম চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে মশিউর ও তার ছেলে শিবলু একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলে।
উল্লেখ্য, গত ৭ ডিসেম্বর দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ ২৭ মামলার আসামি মশিউর রহমানকে ওই এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। মশিউর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসেবে পরিচিত। সে খুলনা জেলার ফুলতলা থানার পায়গ্রামের মৃত কাজী গোলাম হাসানের ছেলে। ওই সময় তার কাছ থেকে দেশি-বিদেশি কয়েকটি অস্ত্র ও ১৩ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। এই সন্ত্রাসী গ্রুপটি একযুগেরও বেশি সময় ধরে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, সরকারি পাহাড় দখল করে প্লট বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর ছেলে শিবলু ওই বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এর আগে, গত ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর সলিমপুর এলাকা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মশিউর। তখন তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ওয়ান শ্যুটারগান এবং ৫টি এসবিবিএল ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল। তখন ধরা না দিতে তিনি বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। পরবর্তীতে কারাগার থেকে বাইরে এসে এলাকায় নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেন নিজের ছেলে শিবলুকে নিয়ে।
জঙ্গল সলিমপুরের ভৌগোলিক অবস্থান সীতাকুণ্ড উপজেলায় হলেও এর যাতায়াত নগরীর বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে। বিগত কয়েক দশক ধরে সেখানে পাহাড় কেটে চলছে প্লট বেচাকেনা, গড়ে উঠেছে অর্ধ লক্ষাধিক লোকের বসতি। গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সরকারি খাস জমিতে গড়ে তোলা এই ঝুঁকিপূর্ণ বসতি এখন পরিণত হয়েছে ছিন্নমূলের ‘দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্যে’। পরিষদ নেতাদের অনুমতি ছাড়া সেখানে গণমাধ্যমকর্মী এবং সাধারণ লোকজনের প্রবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল একটা সময়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশুরু হচ্ছে চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ
পরবর্তী নিবন্ধজুনে চালু হচ্ছে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল