বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার তোড়জোড়ের মধ্যে ক্যাম্পগুলোতে বিবদমান রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপতৎপরতা বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের গত ছয় মাসে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৩২ রোহিঙ্গা নাগরিক খুন হয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ক্যাম্পে আরসা ও আরএসও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় পাঁচ আরসা সদস্য নিহত হন। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার সকালে আইসিসি’র প্রতিনিধি দলের তথ্য সংগ্রহকালে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হন এক রোহিঙ্গা সাব–মাঝি। এভাবে লাগাতার খুন, অপহরণ, নিরাপত্তাহীনতায় অনেক রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ক্যাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কার্যত প্রত্যাবাসন কর্মসূচি বানচাল করে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে নিজেদের মধ্যে একাধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু পয়েন্টকে সামনে নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে।
উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়ার কয়েকটি ক্যাম্পকে ঘিরে গুরুতর অপরাধের ঘটনা উদ্বেগজনক। চলতি বছরের গত ছয় মাসে উখিয়ার বালুখালী মেগা ক্যাম্পের ৮/ই, ৮/ডব্লিউ, ৯, ১২, ১৩ ও ১৯ নম্বর এবং কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের ১/ ই, ২/ ডব্লিউ, ৫, ৭, ১৭ ও ১৮ নম্বর ক্যাম্পে উল্লেখযোগ্য হারে অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এতে হত্যা, অস্ত্রবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, লাশ গুম, মাদক, মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাকারবারির ঘটনা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ ব্যাপারে ৮ এপিবিএন পুলিশের এএসপি মো. ফারুক আহমেদ জানান, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেড়েছে হানাহানি ও খুনোখুনি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৭ জুলাই পর্যন্ত এসব ক্যাম্পে অন্তত অর্ধশতাধিক সহিংস ঘটনায় অন্তত ৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, গুমের ঘটনাও চলছে সমানে। নিখোঁজ রয়েছে অনেক রোহিঙ্গাও। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চার বছরে ১২৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র জানায়, কুতুপালং ও বালুখালী মেগা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপতৎপরতা অনেকটা বেশি। প্রকাশ্যে দিন দুপুরে মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আইন–শৃক্সখলা পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে বলে সূত্রগুলোর অভিমত। এ অবস্থায় ক্যাম্প সংলগ্ন আশপাশের এলাকার লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন। স্থানীয় লোকজন ও সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় পুনরায় সেনাবাহিনী নিয়োজিত করার দাবি করছে। প্রায় সব বিবদমান সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে ক্যাম্প, ব্লক ও উপ–ব্লক ভিত্তিক এলাকার নিয়ন্ত্রণ, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ধরে রাখা, চলমান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে তা বানচাল করতে নানা নাশকতার পরিকল্পনা করেছে ওরা। এমনিতে প্রায় সব ক্যাম্পে কম বেশি রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোর তৎপরতা থাকার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৭ সালে ব্যাপক আকারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দেশান্তরিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পুরোটার পেছনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি বা আরসা। সেই সুবাদে প্রথম ৩–৪ বছর ধরে একচ্ছত্রভাবে ক্যাম্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ করত ওরাই। বিশেষ করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার পর আরসা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
অবশ্য এর আগে থেকে ক্যাম্পগুলোতে বিচরণ করার চেষ্টা করে আসছিল আরো বেশ কিছু সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ ও সংগঠন। কিন্তু তেমন সুযোগ পাচ্ছিল না। মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার পর সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে আরসা বিরোধী সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠতে থাকে। এর আগের বছর ২০২০ সালের অক্টোবরে কুতুপালং ১/ওয়েস্ট ক্যাম্পে মারকাজের পাহাড়ে আরসা সন্ত্রাসীরা তাদের দলচ্যুত মাষ্টার রফিক প্রকাশ মুন্নার ভাই, ভগ্নিপতিসহ চারজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
২০২১ সালের অক্টোবরে কুতুপালং ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসা ঘিরে ঘুমন্ত ও পলায়নপর ৬ জনকে গুলি ও জবাই করে খুন করেছিল আরসা। রোহিঙ্গা মৌলভীদের পরিচালিত ‘ইসলামি মাহাজ’ নামের সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঐ মাদরাসাটি। কার্যত এসব উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী থেকে আরসার ওপর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আস্থা ও নির্ভরতা কমতে শুরু করে।
আরসার কাউন্টার হিসেবে রোহিঙ্গাদের পুরনো রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন আরএসও এর পাশাপাশি তাদের ব্রাদারহুড হিসেবে তৎপর রয়েছে নবী হোসেন গ্রুপ, মাস্টার মুন্না গ্রুপ, ইসলামি মাহাজ, এআরএনও, নসরুল্লাহ গ্রুপ, আবু আনাস গ্রুপ, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ।
নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা সচেতন ব্যক্তি জানান, লাগাতার খুনোখুনির ঘটনায় তারা ক্যাম্পে বেশ বিপন্ন বোধ করছেন। এজন্য ছেলে–মেয়ে, পরিবার পরিজনদের নিয়ে অনেকে ক্যাম্পের বাহিরে বাসা ভাড়া নিয়ে দিন কাটাচ্ছে বাধ্য হয়ে। অনেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসায় অথবা পুরনো স্বজনদের সাথে থাকছে। ক্যাম্পে সাধারণ দরিদ্র পরিবার ছাড়া শিক্ষা দীক্ষায় মোটামুটি সচেতন রোহিঙ্গা পরিবারগুলো চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছে বলে অনেক রোহিঙ্গা জানান।