চট্টগ্রাম বন্দরের গাড়ির চাপ সামলাতে প্রায় ৩ হাজার ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় এবং চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে বন্দর টোল রোড। নির্মিত হচ্ছে আলাদা সার্ভিস লেনও। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সলিমপুর থেকে বন্দরের গেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টোল রোড সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সরকার নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক যানজট বহুলাংশে কমে যাবে। শহরের যান চলাচলেও গতি আসবে। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে প্রকল্পটির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারী টোল রোড এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড প্রতিদিন বাড়ছে। বাড়ছে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও। প্রতি বছর প্রবৃদ্ধি ঘটছে বন্দরে। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৩৩ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। একই সময়ে তের কোটি টনের মতো পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর পঞ্চাশ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের বেশি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং কন্টেনার মুভার যাতায়াত করে। বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে এসব গাড়ি দেশের নানা স্থানে যায়, আবার একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য নিয়ে বন্দরে আসে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়িও বন্দরে যাতায়াত করে। বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহনের চাপ সামলাতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বন্দরের গেট থেকে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সলিমপুর পর্যন্ত ১১ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০২ সালে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ১শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুই লেনের রাস্তাটি চালু করা হয় ২০০৭ সালে। বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে রাস্তাটিতে টোল আরোপ করা হয়। এটির নাম হয়ে যায় বন্দর টোল রোড।
টোল রোড বন্দরের যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকার পাশাপাশি হালিশহর উপকূলীয় এলাকা আবাসনসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দিনে দিনে বন্দরের গাড়ির চাপ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় দুই লেনের এই রাস্তাটি চাহিদা মেটাতে পারছে না। বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহনের জটে পতেঙ্গা–হালিশহর এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে বহুদিন ধরে। যানজটে ত্যক্ত–বিরক্ত হয়ে এলাকাবাসী ইতোমধ্যে মানববন্ধন করেছেন। তারা বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যানজট থেকে রক্ষা পেতে আকুতি জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, বিশ বছরের বেশি সময় আগে বন্দর টোল রোডের জন্য নেওয়া প্রকল্পে ভবিষ্যতের চিন্তা করা হয়নি। রাস্তাটি মাত্র দুই লেনের। ২৪ ফুট প্রস্থ রাস্তাটি বর্তমানের গাড়ির বিশাল চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আউটার রিং রোডের সাথে এই টোল রোড যুক্ত করায় রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার বাড়তি গাড়ি চলাচল করছে। ভবিষ্যতে রাস্তাটিতে গাড়ির চাপ আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। বে টার্মিনাল চালু হলে এই রাস্তাটির উপর চাপ অনেক বাড়বে।
বন্দরকেন্দ্রিক গাড়ির চাপ সামলানো, বে টার্মিনালের গাড়ি চলাচল এবং আউটার রিং রোডের গাড়ির সুবিধা নিশ্চিত করতে দুই লেনের বিদ্যমান টোল রোডকে ছয় এবং চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হবে সার্ভিস রোডও। সড়কটি নির্মাণে আগামী অন্তত পঞ্চাশ বছরের লক্ষ্য সামনে রাখা হয়েছে।
৩ হাজার ১৭৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহীত প্রকল্পে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে এডিবি ঋণসুবিধা দেবে ১ হাজার ১৯৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সাড়ে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ টোল রোডের সলিমপুর থেকে শুরু করে প্রথম সাড়ে ৭ কিলোমিটারকে ছয় লেন মূল সড়কের পাশে (কান্ট্রিসাইডে) সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। বাকি প্রায় চার কিলোমিটার মূল সড়ক ৪ লেনের এবং উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পটিতে ১৫৮ দশমিক ৫২ মিটার লম্বা একটি সেতু, ৩৯১ দশমিক ১৬ মিটার দীর্ঘ একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ, ১৪২ দশমিক ১৮ মিটার দীর্ঘ ৯টি ওভারপাস, ৪৮৯ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ২৬টি কালভার্ট, চারটি স্লুইচগেট এবং একটি টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ রয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানান, প্রকল্পটিকে সরকার গুরুত্ব সহকারে দেখছে। প্রকল্পটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারী প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। প্রকল্পের ব্যয়ের খাতগুলো যৌক্তিক কিনা তা–ও খতিয়ে দেখা হয়েছে। সবকিছু ঠিকভাবে এগোলে অচিরেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।