ছয় আসনে বিএনপির ৯ ‘বিদ্রোহী’

দুটি মনোনয়নপত্র জমা দেন রাউজানের গিয়াস কাদের

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ১৭ জনকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। তবে এদের বাইরে দলটির আরো ৯ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। পৃথক ছয় আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেন তারা। অর্থাৎ ১৬ আসনে বিএনপির ২৬ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে রাউজান থেকে বিএনপি’র ভাইসচেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী দুটি মনোনয়নপত্র জমা দেন। একটিতে বিএনপি এবং অপরটি ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীর। এছাড়া দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যারা মনোনয়নপত্র জমা দেন তারাও স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন।

বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে জমা দেয়া মনোনয়নপত্রের তালিকা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সবচেয়ে বেশি ৩ বিএনপি নেতা মনোনয়নপত্র জমা দেন চট্টগ্রাম১৪ (চন্দনাইশ) আসনে। এছাড়া হাটহাজারীতে ২ জন, বাঁশখালী, মীরসরাই, আনোয়ারা ও পটিয়ায় একজন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে।

দুইভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেন গিয়াস কাদের : চট্টগ্রাম(রাউজান) আসনের দলের প্রার্থী কে তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট করেনি বিএনপি। তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস কাদের চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকারকে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। দুইজনই গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন গোলাম আকবর খোন্দকার। এদিকে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী দুইভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে তার একটি প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর আগে রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (ইউএনও) পরান্টু চাকমার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে সাকের কাদের চৌধুরীসহ উপজেলা বিএনপি’র কয়েকজন সিনিয়র নেতা।

সশরীরে উপস্থিত হয়ে মনোনয়নপত্র জমা না দিলেও গতকাল সকালে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী তার দুই ছেলে সামির কাদের ও সাকের কাদের চৌধুরীকে নিয়ে উপজেলা সদরের মুন্সিরঘাটায় আসেন। এসময় তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, গত দেড় মাস সকালে একটি, বিকেলে আরেকটি বার্তা পেতাম। এতে আমি বিচলিত হতাম না। এতে আমার মনে হয়েছে, আমার দল একটি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। যাই হোক, রাউজানের রক্ত আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এই রক্ত এবং আপনাদের রক্ত রাউজানের মাটিতে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে নির্বাচন করবেই করবে।

এদিকে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর গোলাম আকবর খোন্দকার উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে আমার দল ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মূল্যায়ন করেছেন। সর্বশেষ ২৭ ডিম্বের আমাকে দল থেকে মনোননয়পত্র দিয়েছে। আমি দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও দখলদারমুক্ত রাউজান গড়তে কাজ করতে চাই। জনগণ যদি আমার উপর তাদের আস্থা রাখে আমি অবশ্যই উন্নয়নের মাধ্যমে এর প্রতিদান দেবো ইনশাল্লাহ।

জানা গেছে, গিয়াস কাদের চৌধুরী ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরপর অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিএনপি’র প্রার্থী হলেও পরাজিত হন। এদিকে গোলাম আকবর খোন্দকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এর পর থেকে রাউজানে সক্রিয় হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের এক গ্রুপ গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং অপর গ্রুপ গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারি। বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষেও জড়ান তারা। ৫ আগস্টের পর থেকে রাউজানে ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের দাবি, দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণেই সংঘটিত হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ড।

বাঁশখালীতে লেয়াকত : চট্টগ্রাম১৬ (বাঁশখালী) আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরীকে। কিন্তু আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহবায়ক লেয়াকত আলী। তিনি ২০০৩ থেকে তিন দফায় গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্র্বাচিত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য সর্বশেষ গত রোববার চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। লেয়াকত আলী ২০০৯ এবং ২০১৪ সালেও বিএনপি’র বিদ্রোহী হিসাবে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।

জানা গেছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ জেলা বিএনপির ৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন লেয়াকত আলী। পরবর্তীতে ৬ মে ওই কমিটির আকার বৃদ্ধি করা হয়। তখন বাদ পড়েন লেয়াকত আলী।

হাটহাজারীতে ফজলু ও শাকিলা : চট্টগ্রাম(হাটহাজারী) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। কিন্তু গতকাল স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এস.এম. ফজলুল হক ও বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার সাকিলা ফারজানা।

মীরসরাই, আনেয়ারা ও পটিয়ায়ও আছেন একাধিক প্রার্থী: চট্টগ্রাম(মীরসরাই) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহবায়ক নুরুল আমিন। তবে আসনটিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতা শহীদুল ইসলাম চৌধুরীও।

এদিকে চট্টগ্রাম১২ (পটিয়া) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবাক এনামুল হক এনাম। এ আসনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ সাদাত আহমেদ।

চট্টগ্রাম১৩ (আনোয়ারাকর্ণফুলী) আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজামকে। এ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আলী আব্বাস। এর আগে সরওয়ার জামালের দলীয় মনোনয়ন বাতিল করতে আলী আব্বাসসহ তিন নেতা চিঠি দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে।

বিদ্রোহীর ছড়াছড়ি চন্দনাইশে : দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তিন বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র পত্র জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) আসনে। এরা হচ্ছেনদক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক সহসভাপতি এডভোকেট মিজানুল হক চৌধুরী, বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম রাহী ও চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আনোয়ার।

এ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন নিয়ে ২০২৪ সালে চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া জসিম উদ্দিন আহমেদকে। তিনিও গতকাল মনোননয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডার এক হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে কারাগারেও যান তিনি।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া শফিকুল ইসলাম রাহী আজাদীকে বলেন, আমিসহ বিএনপি’র ছয়জন দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। এদের যে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হলে দল অবশ্যই উপকৃত হতো। কারণ ৬ জনই বিএনপি’র কর্মী। এখন যাকে দেয়া হয়েছে তিনি বিএনপির কেউ না।

উল্লেখ্য, বিএনপি ছেড়ে ২০০৬ সালে নতুন দল ‘লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ (এলডিপি) গঠন করেন কর্নেল (অব.) . অলি আহমদ বীর বিক্রম। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গেই ছিল এলডিপি। তাই বিগত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) আসনটি জোটের শরীকদল এলডিপি’কে ছেড়ে দেয় বিএনপি। কিন্তু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১০ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছে এলডিপি। এখানে জোটটির প্রার্থী হয়েছেন কর্নেল অলির ছেলে ওমর ফারুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা আজ গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরে পাওয়ার দিকে যাচ্ছি
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচনের পালে হাওয়া