চিকিৎসকদের কোনো চেষ্টাই কাজে এল না; বাঁচানো গেল না মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আট বছর বয়সী ছোট্ট আছিয়াকে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয় বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর– আইএসপিআর জানিয়েছে। এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
ধর্ষণের শিকার শিশুটির মরদেহ গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় নেয়া হয়। পরে শহরের নোমানী ময়দানে প্রথম জানাজা এবং শ্রীপুর উপজেলা জারিয়া গ্রামে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে শ্রীপুরের সোনাইকুন্ডি গ্রামের স্থানীয় কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে শিশুটি মাগুরা সদর উপজেলার যে বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেই বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে উপজেলার নিজনান্দুয়ালী গ্রামের হিটু মিয়ার বাড়িতে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা ওই বাড়িতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানান ঘটনাস্থলে থাকা ওই গ্রামেরই বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। এদিকে ধর্ষণের ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবিতে ঢাকা–খুলনা মহাসড়ক অবরোধ বিক্ষোভ করছে স্থানীয় জনতা। রাত ৮টার দিকে তারা মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে সড়কের উভয় পাশে যানজটের সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৬ মার্চ শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির মা গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজীবের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগম (৪০)। তাদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার নথিতে বলা হয়, সজীবের সহায়তায় তার বাবা হিটু মিয়া শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি জাবেদা ও তার ছোট ছেলেও জানতেন। ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যার চেষ্টা চালান তারা।
নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ৬ মার্চই তাকে ঢাকা মেডিকেলের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) ভর্তি করা হয়। পরে শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা শনিবার জানিয়েছিলেন, শিশুটির অবস্থা সংকটাপন্ন। এরপর তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও সন্ধ্যায় তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল–সিএমএইচে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, আজ সে আরও দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়েছে। দ্বিতীয়বার প্রায় ৩০ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পর হৃৎস্পন্দন ফিরেছে, তবে তার মস্তিষ্ক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। কোমা স্কেলে (জিসিএস) মাত্রা ৩, যা গভীর অচেতন অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। শিশুটির রক্তচাপ ও অঙিজেনের মাত্রাও বিপজ্জনকভাবে কম। এরপর দুপুরে শিশুটির মৃত্যুর খবর দেয় আইএসপিআর। সেখানে সেনাবাহিনীর তরফে শোক প্রকাশ করা হয়।
আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির আজ সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি।
সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে মরদেহ পৌঁছে মাগুরায় : ধর্ষণের শিকার আট বছরের শিশুটির মরদেহ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় নেয়া হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের দিকে হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। এ সময় তার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, আমার মেয়ের ধর্ষণকারীদের ফাঁসি চাই। আমার মনিরে বেলেট দিয়ে কেটে কেটে হত্যা করতে চেয়েছিল। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাগুরা জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা।
পরে মরদেহটি সেনাবাহিনী ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে শ্রীপুর উপজেলা জারিয়া গ্রামে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহের সঙ্গে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় আসেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ।
জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার কাজ শেষ করতে হবে। ধর্ষণের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে এ কারণে যেন আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে সাহস না পায়।
শোকাচ্ছন্ন মাগুরার জারিয়া গ্রাম : মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া আট বছরের শিশুটির বাড়িসহ গোটা এলাকায় এখন শোকের মাতম। শিশুটির মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা কিছুই বলতে পরছেন না। বুক চাপড়ে কাঁদছেন ভাইবোনসহ আত্মীয়–স্বজনরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে মাগুরার শ্রীপুরে জারিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মৃত্যুর খবর শুনে সবাই ভিড় করছেন শিশুটির বাড়িতে।
স্থানীয় সব্দালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পান্না খাতুন বলেন, আমাদের একটাই দাবি, হিটু শেখসহ চার আসামির ফাঁসি। একই ইউনিয়নের সদস্য রূপ কুমার বলেন, আমরা শুধু ফাঁসি চাই না। এটা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়, সেই দাবি সরকারের কাছে রাখছি। জারিয়া গ্রামের সবার মুখে মুখে একটাই দাবি, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’। একই সঙ্গে বিচার কার্যক্রম যেন কোনোভাবে বিলম্বিত না হয় সেই দাবিও তাদের।
এদিকে, যে বাড়িতে শিশুটি ধর্ষিত হয়েছে সেই বাড়িটি এখন এলাকাবাসীর কাছে ‘ধর্ষক হিটু শেখের’ বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাড়িটিতে এখন কেউ নেই। বাড়ির মালিক ধর্ষক হিটু শেখ, তার স্ত্রী জাবেদা বেগম, দুই ছেলে সজীব শেখ, রাতুল শেখ সবাই কারাগারে।
অন্যদিকে বিকালে শিশুটির মরদেহ হেলিকপ্টারে করে মাগুরা জেলা স্টেডিয়ামে আসার পর শহরের নোমানী ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে তাকে শ্রীপুরের সোনাইকুন্ডি গ্রামে কবরস্থানে দাফন করা হয়। গোটা কবরস্থানের আশপাশ শিশুটির স্বজনসহ গ্রামবাসীর কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠেছে।
বিচার শুরু ৭ দিনের মধ্যে : মাগুরায় শিশু ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ আগামী ৭ দিনের মধ্যে শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা বলেন, আজই পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদন মিলবে। ডিএনএ প্রতিবেদনের একটা প্রক্রিয়া থাকে। আশা করছি, আগামী ৫ দিনের মধ্যে তা পেয়ে যাব। এরই মধ্যে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে ১২–১৩ জনের । আমরা আশা করছি, ৭ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু হবে।
উপদেষ্টা বলেন, আপনারা জানেন, ধর্ষণের মামলায় অতীতে বিচার শুরু হয়ে সাত–আট দিনের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার নজির আছে অব্যাহত শুনানির মাধ্যমে। ৭ দিনের মধ্যে ইনশাল্লাহ যদি আমরা বিচার কাজ শুরু করতে পারি, আমাদের বিচারকরা, ওনারা সর্বোচ্চ দ্রুততার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেই রায় দিতে পারবেন। আসিফ নজরুল বলেন, ধর্ষণ একটি ব্যক্তি পর্যায়ের অপরাধ। আমরা নিশ্চিত করতে চাই এখানে আমাদের বিন্দুমাত্র অবহেলা নাই।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আজ এই মর্মান্তিক খবর পাওয়ার পর চিকিৎসকরা সময় বাঁচানোর জন্য নিজেরা সিএমএইচে গিয়ে দ্রুত সময়ে পোস্ট মোর্টেম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের মন দুঃখে ভরে আছে। আমাদের কর্মে কোনো রকম অবহেলা হবে না।
আসিফ নজরুল বলেন, নতুন আইনের প্রাথমিক ড্রাফট হয়েছে। আপনারা জানেন, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কনসালটেশন করতে হয়। আমরা আশা করছি, আগামী রোববার, খুব দেরি হলে সোমবার আমরা নতুন আইন প্রণয়ন করে ফেলব। তিনি বলেন, নতুন আইনে শুধু একটা বিষয় অ্যাড করতে চাই। শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের দ্রুত বিচার নিশ্চিতে আমরা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে যাচ্ছি। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান নতুন আইনে থাকবে। এ ট্রাইব্যুনালের কাজ হবে শুধু শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনা দ্রুত বিচার করা। যেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া যায়।
সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ করে উপদেষ্টা বলেন, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, আপনারা তাদের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোনো নৈরাজ্য আমরা বরদাশত করব না। আমাদের ভুলত্রুটি থাকলে বলবেন। অবশ্যই আমরা রেসপন্স করব, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করব। আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো ভুল নাই এবং ইনশাল্লাহ আমরা চেষ্টা করব ভবিষ্যতে ভুল হলে কারেক্ট করার জন্য।