ছোটো কাগজ শিশুসাহিত্য : নবীন-প্রবীণ লেখকের সমাহার

রেজাউল করিম | শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করা হলেও সবকিছু এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক। কোনো কিছুর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে নেই। কেন্দ্রায়ন হয়েছে শুধু, বিকেন্দ্রায়ন হয়নি। কিন্তু শিল্পসাহিত্যসহ আরো অনেক সৃষ্টিশীলতায় চট্টগ্রাম এগিয়ে। চট্টগ্রামকে বলা হয় ছড়ার রাজধানী। এই চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি। যা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। প্রায় প্রতিবছর বিশাল আকারে শিশুসাহিত্য উৎসব এই চট্টগ্রামেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর শিল্পকলায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শিশুসাহিত্য উৎসব। সারা বছর নানা আয়োজন তো আছে। এতে করে শিশুসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। উৎসবকে ঘিরে ছোটো কাগজ শিশুসাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে।

এবারের শিশুসাহিত্য সংখ্যাটি বেশ ঢাউস আকারের। সম্পাদনা করেছেন শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ। নির্বাহী সম্পাদকআজিজ রাহমান। সম্পাদনা পরিষদে আছেনবিপুল বড়ুয়া, ইসমাইল জসীম ও আরিফ রায়হান। মনকাড়া প্রচ্ছদ আঁকিয়ে উত্তম সেন। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম কামাল উদ্দীন। শিল্প সম্পাদক নাটু বিকাশ বড়ুয়া। প্রকাশক : বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি। ৫২৮ পৃষ্ঠার শিশুসাহিত্যের দাম রাখা হয়েছে মাত্র ৫’শ টাকা। ঝকঝকে অফসেট পেপারে প্রকাশিত শিশুসাহিত্য সংগ্রহে রাখার মতো। উৎসর্গ করা হয়েছেলেখকশিশসংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী প্রদীপ ভট্টাচার্যকে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে ছোটো কাগজ শিশুসাহিত্যের এ সংখ্যায় যেসব পত্রস্থ হয়েছে, সেগুলো বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে যেমন নতুন, তেমনি আকর্ষণীয়। তবে ছড়াকবিতার বিষয়ে কিছুটা উদারতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

শিশুসাহিত্যে আমার বই, আমার লেখা অধ্যায়ে যাঁরা লিখেছেন লুৎফর রহমান রিটন, রফিকুর রশীদ, প্রদীপ দেওয়ানজী, সৈয়দ জিয়াউদ্দীন। শিশুসাহিত্যস্রষ্টা ও সৃষ্টি অধ্যায়ে লিখেছেনসুজন বড়ুয়া, আনজীর লিটন, মিলন কান্তি দে, আনসার উল হক, . মুন্সী আবু বকর, . উদিতি দাশ, . সানাউল্লাহ আলমুবীন, শাকিল আহমদ, চন্দন কৃষ্ণ পাল, ইকবাল হায়দার, তরুণ কান্তি বড়ুয়া, তহুরীন সবুর ডালিয়া, অরুণ শীল, আজিজ রাহমান, রমজান মাহমুদ, মৃণালিনী চক্রবর্তী, কামরুল আনোয়ার চৌধুরী, আবুল কালাম বেলাল, শিবুকান্তি দাশ, বাসুদেব খাস্তগীর, জসিম উদ্দিন খান, কাঞ্চনা চক্রবর্তী, অমিত বড়ুয়া, গোফরান উদ্দীন টিটু, নিজামুল ইসলাম সরফী, ইলিয়াস বাবর, পিংকু দাশ, গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন, শিউলি সিরাজ, কানিজ ফাতেমা, সুবর্ণা দাশ মুনমুন, কুমুদিনী কলি, আহমাদ স্বাধীন, সৈয়দা করিমুননেসা এবং রাশেদ রউফ। গল্প লিখেছেন মোহিত কামাল, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশ্‌শিরা, মাহফুজুর রহমান, নাসের রহমান, দীপক বড়ুয়া, জুলফিয়া ইসলাম, শারমিন মুস্তারী, কুমার প্রীতীশ বল, নাহিদা আশরাফী, আইরিন নিয়াজী মান্না, ওবায়দুল সমীর, সাঈদুল আরেফীন, ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, বিচিত্রা সেন, ইফতেখার মারুফ, সৌরভ শাখাওয়াত, হেলাল চৌধুরী, কাসেম আলী রানা, শাহেদ আলী টিটু, আকাশ আহমেদ, রোকেয়া হক, মেরিনা সুলতানা, লিপি বড়ুয়া, পুস্পিতা সেন, কৌশিক রেইন, পারভীন রব্বানী, মলিনা মজুমদার, ইলিয়াছ হোসেন, ছন্দা চক্রবর্তী, সিমলা চৌধুরী, নাজনীন আমান, আখতারুল ইসলাম, সুব্রত কুমার নাথ, মাইছুরা ইশফাত, স্বপন কুমার বড়ুয়া, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, শাহীন আক্তার, তাহেরা বেগম, শামীম ফাতেমা মুন্নী, রশীদ এনাম, শিরিন আফরোজ, নাছিমা শওকত, নূরনাহার নিপা, শিপ্রা দাশ, কাজী নাজরিন, অনিক শুভ। প্রসঙ্গ : শিশু ও তাদের সৃজনশীলতা অধ্যায়ে লিখেছেন রীতা দত্ত, এস এম ওমর ফারুক, রুনা তাসনিমা, আয়েশা পারভীন চৌধুরী, ফারহানা ইসলাম রুহী, মো. দিদারুল আলম, ঝর্ণা বড়ুয়া, . সবুজ বড়ুয়া শুভ, নেছার আহমেদ খান, গৌতম কানুনগো, নেভী বড়ুয়া, শিমলী দাশ, রিনিক মুন, গৌরী সর্ববিদ্যা, অঞ্জনা রায় চৌধুরী, এস. টি. এফ. যুঁথী, মনোয়ার হোসেন রতন, রনিতা জামান, ফারজানা আজিম, অনামিকা বড়ুয়া। স্মরণের আবরণে অধ্যায়ে লিখেছেন নেছার আহমদ, কায়েস চৌধুরী, ইসমাইল জসীম। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি লিখেছেন রুমানা শফী। ছড়া ও কবিতা লিখেছেন অজয় দাশগুপ্ত, অপু চৌধুরী, অপু বড়ুয়া, অভি ওসমান, আতিক রহমান, আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ, আরজাত হোসেন, আল জাবেরী, আলমগীর খোরশেদ, আলী আকবর বাবুল, আলেক্স আলীম, আহসানুল হক, আহমেদ মাওলা, আহসান মালেক, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, উজ্জ্বল সম্পু, এনায়েত হোসেন পলাশ, এয়াকুব সৈয়দ, এস এম তিতুমীর, ওয়াহিদ কায়সার, করুণা আচার্য, কল্যাণ বড়ুয়া, কাজী আনারকলি, কাজী জাহাঙ্গীর, কামরুন ঋজু, কামরুন নাহার, কাশেম আদনান, কুতুবউদ্দিন বখতেয়ার, কেশব জিপসী, ক্যামেলিয়া আহমেদ, খুকু আহমেদ, খোদেজা মাহবুব, গোলাম নবী পান্না, চাঁদ সুলতানা নকশী, চন্দ্রশিলা ছন্দা, জসিম উদ্দিন মাহমুদ, জাকির হোসেন কামাল, জাবীদ মাইন্‌উদ্দীন, জালাল খান ইউসুফী, জায়তুন নেসা জেবু, জাহেদ কায়সার, জি এম জহির উদ্দীন, জিন্নাহ চৌধুরী, ঝিনুক জোবাইদা, ডি কে বড়ুয়া, তপংকর চক্রবর্তী, তানজিনা রাহী, তারিফা হায়দার, তালুকদার হালিম, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, দিলরুবা খানম রুবি, নাঈমা হক, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, নাটু বিকাশ বড়য়া, নান্টু বড়ুয়া, নার্গিস জাহান, নাসিম আখতার রিনা, নাহিদ নেওয়াজ, নাহিদ সুলতানা, নিগার সুলতানা, নিশাত হাসিনা শিরিন, নীল রতন দাশগুপ্ত, নীহারেন্দু বড়ুয়া, নুরুন্নাহার ডলি, নুসরাত সুলতানা, পারভীন শাহনাজ, পাশা মোস্তফা কামাল, পুলক চন্দ, পুষ্প বড়ুয়া, প্রতিমা দাশ, প্রদীপ ভট্টাচার্য, প্রদ্যোত কুমার বড়ুয়া, ফারজানা নাজ শম্পা, ফারজানা রহমান শিমু, ফারুক আহমেদ রাজু, ফারুক হোসেন, বদরুননেসা সাজু, বিকাশ বড়ুয়া, বিপ্লব গাঙ্গুলী, মনজু আলম, মর্জিনা আখতার, মল্লিকা বড়ুয়া, মারজিয়া খানম সিদ্দিকা, মারুফুল ইসলাম, মাসুদ আনোয়ার, মাসুম আওয়াল, মাহফুল আখতার, মাহবুব পলাশ, মাহবুবা চৌধুরী, মিজানুর রহমান শামীম, মিতা দাশ, মিতা পোদ্দার, মিনতি দাশ, মির্জা মোহাম্মদ আলী, মুকুল চৌধুরী, মুসতাফা আনসারী, মেহেরুন নেসা রশিদ, মোহাম্মদ আনিস শাহরিয়ার, মোহাম্মদ নেছার, মোহিনী সংগীতা সিংহ, যতন কুমার দেবনাথ, রহীম শাহ, রাসু রড়ুয়া, রাহগীর মাহমুদ, রিফাত ফাতিমা তানসি, রুমি বড়ুয়া, রূপক কুমার রক্ষিত, লিটন কুমার চৌধুরী, লিপি তালুকদার, লিয়ন আজাদ, লুনা দাশগুপ্তা, শওকত আলী সুজন, শরণংকর বড়ুয়া, শর্মি বড়ুয়া, শায়লা রহমান তিথি, শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক, শাহিদা আয়শা, শাহী মোহাম্মদ ইলিয়াছ, শিউলি নাথ, শুকলা আচার্য্য, শুকলাল দাশ, শেখ মঈনুল হক চৌধুরী জোসেফ, শেলীনা আকতার খানম, শৈলেন্দ্র হালদার, সজল দাশ, সনজিত দে, সনজীব বড়ুয়া, সনতোষ বড়ুয়া, . . শামসুল আলম, সরওয়ার আরমান, সাইফুদ্দিন আহমদ সাকী, সাইফুল্লাহ কায়সার, সাদরুল উলা, সালাম সৌরভ, সিতাংশু কর, সুইটি চৌধুরী পূর্বা, সুজন সাজু, সুপর্ণা লিপি বড়ুয়া, সুবর্ণা বড়ুয়া, সুব্রত চৌধুরী, সুলতানা নুরজাহান রোজী, সুস্মিতা তালুকদার মিতুল, সুসেন কান্তি দাশ, সেলিম তালুকদার আকাশ, সোমা মুৎসুদ্দী, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, সৈয়দা সেলিমা আক্তার, হাসনাত আমজাদ, হৃদয় হাসান বাবু। আছে সম্মাননাপ্রাপ্তদের নিয়ে বিশেষ আয়োজন। সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেনতাহমিনা কোরাইশী, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, আনোয়ারুল হক নূরী। সম্মাননাপ্রাপ্ত বইয়ের পৃষ্ঠপোষকরা হলেন মো. মাজহারুল হক ও ঢালী মোহাম্মদ শোয়ায়েব নজীর।

আমার প্রথম বই ধুত্তুরির গল্পটায় লুৎফর রহমান রিটন সেকালের মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা তুলে ধরেছেন। ‘আমার বইটি ছাপা হচ্ছিল কবি আবিদ আজাদের প্রেসে।….নতুন লেখক হিসেবে যতোটা অপমান অবজ্ঞা আর অনাদর পাওয়া যেতে পারে তার পুরোটাই আমি পেয়েছিলাম প্রকাশক আর স্টল মালিকদের কাছ থেকে। মাত্র পাঁচটি বই ডিসপ্লেতে রাখার কাকুতি মিনতি করার পর নির্দয় প্রকাশক ও স্টল মালিকের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছে-‘আরে ভাই যান তো! নিজেদের বই রাখারই জায়গা নেই….তাছাড়া আপনার বই কিনবে কে? কেউতো কিনবে না। সুতরাং ঝামেলা না করে যান তো ভাই’(শিশুসাহিত্য, পৃষ্ঠা১২১৪)। প্রথম বইয়ের যাতনা, নতুন লেখককে অবজ্ঞা তখনের মতো এখনো রয়েছে।

সাহিত্যিক রফিকুর রশীদ ‘আমার ছড়া, ছড়ার আমি’ প্রবন্ধে লিখেছেন -‘ছড়ার গঠনশৈলী এবং ছন্দপ্রকরণ নিয়ে যত সব নিরীক্ষার পথ খুলেছে কীর্তিমন্ত বিভিন্ন ছড়াশিল্পীর হাতে, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু আমি নিজে এ ক্ষেত্রে মোটেই নিরীক্ষাপ্রবণ হতে পারিনি সে আমার নিজস্ব সীমাবদ্ধতাই বটে।’ (শিশুসাহিত্য, পৃষ্ঠা ২৫)। লেখকের বিনয়, সারল্য শেষে ফুটে উঠেছে। নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী ‘আমার প্রথম শিশুতোষ নাটক রক্তরাজা সবুজ পরী’ স্মৃতিচারণে লিখেছেন-‘সে কঠিন সময়ে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু জ্ঞানী গুণি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা মানুষ যাঁরা নিজেদের মেধা মননশীলতা শিক্ষানুরাগ ও যুগ দৃষ্টির প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে গণমাধ্যম তথা শিশু কিশোর সাহিত্যের গুরু দায়িত্বটি পালন করেছিলেন তাঁরাই আমাদের শ্রদ্ধাভাজন গুরুজন। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের প্রাচীনতম পত্রিকার সম্পাদক জনাব অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান, চাঁদের হাটের দাদুভাইদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।’ (শিশুসাহিত্য, পৃষ্ঠা : ২৭)। উঠে এসেছে নিজের নাটক শিশুসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকদের কথা।

সুজন বড়ুয়া হাশেম খানের অলঙ্করণ নিয়ে লিখেছেন -‘কেন হাশেম খানের শিশুসাহিত্য অলঙ্করণ সেরা? কারণ তাঁর ছবির অনেকগুলো আকর্ষণীয় দিক আছে। প্রথমত তাঁর রিয়ালিস্টিক বা বাস্তবধর্মী। সরল কিন্তু সরস মজাদার অর্থবহ। তাঁর ছবি দেখে আনন্দ পেতে সময় লাগে না।’ (শিশুসাহিত্য, পৃষ্ঠা ৩১)। হাশেম খানের অলঙ্করণ দেখলেই বুঝা যায়। এটা একজন শিল্পীর বড় গুণ। আনজীর লিটন বর্ণপরিচয় এর পথ বেয়ে’তে লিখেছেন -‘শিশুসাহিত্য কোনো সাধারণ সাহিত্যধারা নয়। শিশুসাহিত্য হচ্ছে সৃজনশীলতার কল্পনার এবং শিক্ষামূলক উপাদানের মিশ্রণ।’ (শিশুসাহিত্য, পৃষ্ঠা ৩৮)। অনেকে শিশুসাহিত্যকে খুবই হালকাভাবে নেন। সহজ মনে করেন। শিশুর জন্য শিশুদের উপযোগী সৃষ্টিকর্ম এতো সহজ নয়। এর স্রষ্টাকে আগে বুঝতে হবে শিশুর মনোজগত। এরপর সৃষ্টির দিকে এগোতে পারবেন। এবারের শিশুসাহিত্য সংখ্যাও অনেক নবীনপ্রবীণের সংমিশ্রণ ঘটেছে। শিশুদের জন্য রচনায় ওদের কথাটা মনোজগতে রাখতে হবে। ছোটো কাগজ শিশুসাহিত্যের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে