ঈদের কাপড় কিনতে আমার বাবার সাথে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম একবারেই শিশুকালে। জীবনে সেই প্রথম নিউমার্কেট দেখা। প্রায় অর্ধ শতকেরও বেশী সময়কাল আগে, তখন সবে মাত্র চট্টগ্রাম শহরে নিউ মার্কেটের গোড়াপত্তন হয়েছিল। সন তারিখ মনে নেই। বাবা সদ্য প্রতিষ্ঠিত গহিরা কলেজের প্রিন্সিপাল। ঈদ আসন্ন। কিছু দিন আগে বাবা আমার আপাকে সিংগার সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিলেন। কারণ আমার মা আর আপা খুব সেলাইকাজ করতেন। উল, ক্রুশি, আর নানা রকমের এম্ব্রয়ডারি কাজ করতেন তাঁরা। বাড়িতে বেগম পত্রিকা, ললনা, টাপুর টুপুর আসতো। মা আর আপা সেলাই আর সূচি কর্মে এসব সাময়িকী ফলো করতেন। তো নিউমার্কেট যাচ্ছি ঈদের কাপড় কিনতে। আপা শিখিয়ে দিয়েছেন, কী কাপড় কিনবো, তিনি সেলাই করবেন তাই। তখন নেট কাপড় চিকেন, ব্রোকেট, কেরোলিন এসবের চল বা ফ্যাশন। বাবা আমি, লাকি আর লুসিকে সাথে নিয়ে গহিরা বাস স্টপেজ থেকে বাসে উঠলেন, সাথে নাজিম মামা নামের একজন ছিলেন। লাকি আর লুসি খুবই ছোট, অবুঝ। আমার বুদ্ধি হয়েছে, সব মনে আছে তাই। নিউমার্কেট যাবো, ঈদের কাপড় কিনতে। কী অসীম আনন্দ। মার্কেটে গিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। কী সুন্দর সুন্দর কাপড়, বড় বড় সব দোকান, আমি কাপড় পছন্দ করলাম। পেয়াজি কালারের ব্রোকেট আর ফিরোজা কালারের নেট কাপড়। সাথে আরো অনেক কিছু নিয়েছিলাম।এটি আমার বাবার সাথে ঈদ, আর নিউ মার্কেট যাবার এক অসাধারণ স্মৃতি। আর ঈদ উদযাপনের জন্য আমরা আমাদের দাদার বাড়ি এয়াছিন নগরের হলদিয়ায় চলে যেতাম। সেই বাড়ি সর্তা খালের পাড়ে অবস্থিত। আমাদের ছোট বেলায় ঈদ হতো শীতকালে। শুষ্ক মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে তলায় নেমে যেতো। আর ঈদের জামাত হতো খালের অপর পাড়ে কবরস্থান সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে। আমরা চান রাতেই বাড়িতে চলে যেতাম। বাড়ির উঠোনে খেলতাম, খালের পানিতে নামতাম, পা ভেজাতাম, আমাদের দাদার পরিবার একান্নবর্তী কৃষি পরিবার। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, খেত ভরা সব্জি, আলু, মরিচ, বেগুন, মিষ্টি আলুসহ কত কিছু। খাল পাড়ের জমি অত্যন্ত উর্বর আর সমৃদ্ধ। এই খালটি এক স্রোতি খাল। এর পানি উত্তর দিক থেকে নেমে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে হালদার সাথে মিশেছে। আরো কিছুদূর গিয়ে এই খালের পানি কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই খালের রূপ বর্ষায় অন্য রকম, প্রচণ্ড প্রমত্তা। খালের দুপাড় পানিতে টইটুম্বুর হয়ে তীব্র গতিতে ছুটতে থাকে। দুপাশের বাড়ি ঘর গাছপালা ভেঙে ফেনিল এই জল রাশি ঢেউয়ের তালে তালে যেন ছুটতে থাকে। জলের গর্জন আর পাড় ভাঙার নিনাদ ছাড়া তখন আর কিছুই চোখে পড়ে না। কখনো বা দুকূল ছাপিয়ে এই জল প্লাবিত করে খেত খামার আর ফসলী জমিকেও। আর এই প্লাবনেই জমি হয়ে উঠতো শক্তিমান আর উর্বর। ফলে ধান, মরিচ, আর নানা রকম সব্জিতে ভরপুর থাকতো প্রতিটি গেরস্থ বাড়ি। ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য আমার বাবা, জ্যাটা, চাচা, ভাইয়েরা এবং পাড়ার মুরুব্বীরা সকাল থেকেই রেডি হতেন। জবাকুসুমের ঘ্রাণ এখনো নাকে লেগে আছে। আতরমাখা সুগন্ধি রুমাল টার রং ও এখনো চোখে ভাসে। আমিও ও নতুন কাপড় পরে বাবার সাথে ঈদগাহতে যেতাম। সাথে বান্ধবী কাজিন রাও থাকতো। একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল সেখানে। আমরা ছোটরা গাছের ছায়ায় মায়ায় বসতাম। বটফল কুড়িয়ে নিতাম কত যত্নে। নামাজ শেষে কোলাকুলি দেখতাম। এর পরে ঘরে গিয়ে সেমাই, গুড়া পিঠা খেতাম। কোন কোন বাড়িতে মুরগী, গরু রান্না হতো। ভাত খেতাম খুব মজা করে। আর বাড়ির পাশেই হাট। আমার চাচা, বিকেলে আমাদের হাটে নিয়ে যেতেন। মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেতাম, মাল পোয়া, জিলাপী, আমৃত্তি খেতাম।কি মজাই না লাগতো। পেটপুড়ে খেয়ে দেয়ে আবার বাড়ি ফিরতাম। রাতে চাচা উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে কিসসা বলতেন। কী মনোযোগ দিয়েই না শুনতাম। এর পরেই হঠাৎ ছন্দপতন। বাবার মৃত্যু! ঈদের নির্মল আর বেশি বেশি আনন্দের যবনিকাপাত। তবে এই পটপরিবর্তনের পর আমাদের বাসার ঠিকানা বদল, এবং স্থায়ীভাবে রাউজানের নানীর বাড়িতে বাস, সেখানে, নানা নানী, মামা মামী এবং খালাদের অসাধারণ মায়া আর মমতায় প্রতি বছরই ঈদ আসতো নব নব ছন্দে, নবীন আনন্দে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক