ঈদুল ফিতর আর বাংলা নববর্ষ মিলিয়ে এবার তুলনামূলক লম্বা ছুটি ছিল। আর এমন ছুটি পেলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায়? এই ঈদোৎসব ঘিরে আমাদের অন্যতম উৎকণ্ঠা সড়ক দুর্ঘটনা। পৃথিবীর প্রত্যেক জনপদেই বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। কিন্তু কোনোপ্রকার নাশকতা বা দুর্যোগ ছাড়াই শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় এত সংখ্যক মানুষ হতাহতের নজির বাংলাদেশ ছাড়া বোধহয় আর কোথাও নেই।
ঈদের ছুটি কাটিয়ে শহরে ফিরতে ফিরতে এই নিয়ে ভাবছি আর লিখছি। এরমধ্যে গাড়ির উচ্চগতি, ওভারটেকিং, ঝাঁকুনি কিংবা হার্ডব্রেক দেখে অবচেতন মনে মৃত্যুভয় উঁকি দিচ্ছে। ভাবছি, যে নিরাপদ সড়কের আকাঙ্ক্ষা থেকে লিখছি সে সড়ক আমাকে নিরাপদে ফিরতে দিবে তো? যাক, যেহেতু লেখাটা আপনারা পড়ছেন তার মানে শেষমেশ নিরাপদেই ফিরতে পেরেছিলাম। কিন্তু কারো কারো কপালে সে ভাগ্য হয়নি। প্রতি বছরের মতো এবারের ঈদযাত্রায়ও সড়ক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে প্রতিদিনই।
গত মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে বুধবার (১৭ এপ্রিল) ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিমেন্টবাহী একটি ট্রাকের ধাক্কায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গাড়ির ১৪ আরোহী নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামেও ঈদের ছুটিতে ১২ জনের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, গত ৪ এপ্রিল ঈদ যাত্রা শুরুর দিন থেকে গত ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১১ দিনে সারা দেশে ২৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঈদের চার দিনে এক হাজার ২৯৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা নিয়েছে। যাদের মধ্যে ২১২ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। যদিও সব দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৬০ হাজার ৮৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তিন হাজার ৮৬২ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চার হাজার ৪৭৫ জনের। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঈদের মৌসুমেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৭.৩৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের সময়ে যে পরিমাণ নতুন রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে মাত্র ৩,৬০০ কিলোমিটারে সড়ক দিয়ে শুরু করা বাংলাদেশের বর্তমানে ৩,৭৫,০০০ কিলোমিটারে সড়ক রয়েছে। এরমধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে ২২,০০০ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। যা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে হাইওয়ে পুলিশের ৭৩টি ইউনিটের প্রায় ৩ হাজার সদস্য। ইতোমধ্যে দুই লেনের মহাসড়ক চার লেনে পরিণত হয়েছে আর চার লেনগুলো আট লেনে পরিণত হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ফলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এত এত অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল মোতায়েন এবং পরিবহন আইন সংস্কার সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলার অভাব রয়েই গেছে। যা ঈদযাত্রায় প্রকট আকার ধারণ করে।
এসময়ে দুর্ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণে যা দেখা যায়, তা হলো, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ভাঙাচোরা সড়ক, অদক্ষ চালক, দুর্নীতি, ট্রাফিক তদারকির অভাব, অপ্রশস্ত সড়ক, বেপরোয়া গতি, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, তিনচাকার গাড়ি চলাচল ইত্যাদি। পরিবহনের তুলনায় যাত্রী কয়েকগুণ বৃদ্ধি ও পরিবহন মালিকের অতিমুনাফার লোভে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ চালক রাস্তায় নামানো হয়। সড়ক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কর্তব্যে অবহেলা ও দুর্নীতি সড়ক শৃঙ্খলার অন্তরায়। এমনকি মহাসড়কে অনভ্যস্ত শহুরে সিটি বাসগুলো সড়কে চাপ তৈরি করে। আর অধিক ট্রিপ পাওয়ার আশায় বিরতিহীন ও বেপরোয়া গতিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে, অসচেতন যাত্রীরা নিরাপত্তার কথা না ভেবে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে ভ্রমণের বহু পুরনো অভ্যাস তো আছেই। আর যথাযথ রাষ্ট্রীয় তদারকির ঘাটতি আছে। তবে এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে অগণিত মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় এক–তৃতীয়াংশ ঘটে মোটরসাইকেলে।
জ্যাম এড়াতে মহাসড়কে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি যাওয়া, উড়তি তরুণদের বেপরোয়া গতি, নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরিধান না করার কারণে মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এ ঈদেও এসবের ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ২৮ দশমিক ৪টি। এসব দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই মফস্বলে ঘটে। এর কারণ হলো সেখানে ট্রাফিক তদারকি অভাব। গবেষণা দেখা যায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ হেলমেট না পরার কারণে এবং ১২ শতাংশ ত্রুটিযুক্ত হেলমেট পরার কারণে মারা গেছেন।
ছুটির আনন্দ বিষাদে পরিণত হওয়ার এ দায় কার? এর উত্তর ইতোমধ্যেই পরিষ্কার। বলা হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশ–এর পথে হাঁটছে দেশ। আর এমন দেশে অনিরাপদ সড়ক বেমানান। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার হার ও সরকারি–বেসরকারি খাতে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনার মত নিয়ন্ত্রণযোগ্য এ অভিশাপ থেকে বের না হওয়ার কোনও কারণ দেখছি না।
সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ফিটনেস, কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া সকল পরিবহন রাস্তায় নামানো ঠেকাতে হবে। যার মুখ্য ভূমিকা প্রশাসনকে পালন করতে হবে। পাশাপাশি মালিকপক্ষের অতিমুনাফার মানসিকতা পরিহার এবং যাত্রীসাধারণের সচেতনতা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঈদের সময় যাত্রী কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যার চাপ সামলানোর মত পর্যাপ্ত পরিবহন দেশে নাই। তাই সব জেলা–উপজেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এনে, রেললাইন ও কোচ সংখ্যা বৃদ্ধি করে সড়কের উপর চাপ কমিয়ে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
তাছাড়া, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশার মত ক্ষুদ্র যানবাহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ এবং যথাযথ তদারকি করতে হবে। তবে মোটরসাইকেলই যেহেতু অন্যতম প্রধান সমস্যা, তাই এসব উঠতি তরুণ বাইকারদের সচেতন করতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অভিভাবক মহলকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেওয়া যায়। পাশাপাশি বাড়তি সিসির মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। আর সড়ক মেরামত, সম্প্রসারণ, মহাসড়কগুলো ক্রমান্বয়ে শতভাগ চার লেন থেকে আট লেনে উন্নীত করার বিকল্প নেই। এসবের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষ জনবল দিয়ে স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করা সময়ের দাবি। এই ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক ক্যামেরার মাধ্যমে গাড়ির গতিবিধি নজরদারি এবং স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল সিস্টেম চালু করে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও সুসমন্বিত করা যাবে। আর চালক–হেলপারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ঈদসহ সারাবছর নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে চাইলে পরিবহন চালক, সহকারি, মালিক, যাত্রী, হাইওয়ে পুলিশ এবং অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে সবার দায়িত্ব থাকলেও মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে। বাকিরা অসচেতন কিংবা অসতর্ক হতে পারে, ঠিক সে জায়গায় রাষ্ট্রই পারে সবাইকে সঠিক পথ রাখতে। উন্নত সড়ক, যুগোপযোগী আইন, পর্যাপ্ত জনবল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও শিক্ষিত জনগণ সবই আমাদের আছে। অভাব শুধু যথাযথ নিয়মকানুন মেনে চলার মানসিকতার। সাথে আছে এ সমাজের বিষফোঁড়া দুর্নীতি। সবশেষে বলা যায়, আইন মানার মানসিকতা ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দুর্নীতি বিরোধী অবস্থানই পারে স্মার্ট ও নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ,
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।